যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে লিয়োনেল মেসির সফর ঘিরে বিপর্যয়ের পরে ‘শাস্তি’র মুখে পড়েছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি (ভারপ্রাপ্ত) রাজীব কুমার। নজিরবিহীন ভাবে তাঁকে শোকজ় করেছিল নবান্ন। তার জবাবও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার পর থেকে নবান্নে নিজের দফতরে যাননি। অফিস করেছেন তাঁর ভবানী ভবনের দফতর থেকে। মেসিকাণ্ডের ১১ দিনের মাথায় বুধবার প্রথম তিনি ময়দানে নামলেন পুলিশি কর্তব্য পালনে। উর্দি পরে, হাতে ডায়েরি নিয়ে রাজীব পৌঁছে গিয়েছিলেন হুগলির ধনেখালির পুঁইনানে। সেখানেই আগামী ২-৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে চলেছে মুসলিম ধর্মসম্মেলন ‘বিশ্ব ইজতেমা’।
দীর্ঘ ৩২ বছর পরে পশ্চিমবঙ্গে বসছে ‘বিশ্ব ইজতেমা’র আসর। পুঁইনানে কয়েক একর চাষের জমিতে তৈরি হচ্ছে অস্থায়ী তাঁবু। তৈরি হচ্ছে মঞ্চও। বুধবার সেখানে পৌঁছে গোটা এলাকা ঘুরে দেখেন ডিজি রাজীব। ছিলেন উদ্যোক্তাদেরও অনেকে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন রাজীব। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আইজি (আইনশৃঙ্খলা) জাভেদ শামিম, হাওড়ার পুলিশ কমিশনার প্রবীণ ত্রিপাঠী, চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার অমিত পি জাগালভি-সহ জেলা পুলিশের কর্তারা। দেখা যায়, হাতের ডায়েরির সঙ্গে মিলিয়ে ধর্মসম্মেলনের মাঠের পরিকাঠামো যাচাই করছেন ডিজি। সরেজমিনে ঘুরে দেখেন মঞ্চও।
মঙ্গলবার ওই ধর্মসম্মেলনের মাঠ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং সুজিত বসু। বুধবার গেলেন রাজীব। ধর্মীয় জমায়েতের জায়গায় ডিজির আগাম পরিদর্শন নতুন নয়। শ্রাবণীমেলার আগে এই হুগলিরই শেওড়াফুলি এবং বৈদ্যবাটির বিভিন্ন গঙ্গার ঘাট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন ডিজি রাজীব। তবে মেসিকাণ্ডের পরে তাঁর প্রথম প্রকাশ্যে পুলিশি দায়িত্ব পালনে নামা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
আরও পড়ুন:
প্রশাসনের শীর্ষমহলের সঙ্গে রাজীবের সম্পর্কে একদা যে ‘মসৃণতা’ ছিল, তা আর সেই পর্যায়ে নেই বলেই অনেকের অভিমত। যদিও প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউই কিছু বলেননি বা বলেন না। কিন্তু মেসিকাণ্ডের পরে তাঁকে শোকজ় করায় সেই জল্পনা আরও ডালপালা মেলেছে। প্রসঙ্গত, ২০২৬ সালের ৩১ জানুয়ারি রাজীবের সরকারি চাকরিতে অবসর নেওয়ার কথা। আপাতত তিনি রাজ্য পুলিশের ‘ভারপ্রাপ্ত’ ডিজি। নবান্ন সূত্রের খবর, তাঁর পরবর্তী ডিজি-র জন্য তিনটি নাম পাঠানোর জন্য কেন্দ্র থেকে বার্তা এসেছে। আপাতত যা পরিস্থিতি, তাতে ওই তিনটি নামের মধ্যে রাজীবের নাম থাকবে না বলেই প্রশাসনিক মহলের অভিমত। রাজীবের নাম থাকলে তাঁর চাকরির মেয়াদ বাড়বে।
মেসিকাণ্ডের পরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওইদিন সশরীরে মাঠে ছিলেন ডিজি রাজীব। কিন্তু তা-ও অশান্তি রোখা যায়নি। হাজার হাজার মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কার্যত আত্মসমর্পণ করেছিল গোটা পুলিশবাহিনী। নবান্নের তরফে শোকজ়ের নোটিস পেয়েছেন পুলিশের আরও কয়েক জন কর্তা। সাসপেন্ড (নিলম্বিত) হতে হয়েছে বিধাননগরের ডিসি অনীশ সরকারকে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও শুরু হয়েছে। প্রশাসনের একাংশের মতে, মেসি সফরের বিপর্যয়ের পর সাধারণ মানুষ তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতেই মুসলিম ধর্মসম্মেলনকে দেখবেন। অতীতে পুলিশ সফল ভাবে যে কর্মসূচিগুলি উতরে দিয়েছে, তা কেউ মনে রাখবে না। ফলে পুলিশকেও এমন ভাবে কাজ করতে হচ্ছে, যাতে কোনও ফাঁকফোকর না-থাকে।
এমনিতে হুগলির জাঙ্গিপাড়ার ফুরফুরা শরিফে প্রতি বছর ‘উরস উৎসবে’ বিপুল সংখ্যক মুসলিম ধর্মালম্বীর সমাগম ঘটে। তবে এই অনুষ্ঠান তার চেয়েও বহরে অনেক বড়। সূত্রের খবর, এই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নেপথ্যে থেকে কাজ করছেন ফুরফুরার পিরজাদা কাশেম সিদ্দিকি, যাঁকে গত ইদের সময় থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মধ্যে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ফুরফুরার পরে পার্ক সার্কাসের ইফতার পার্টিতে মমতার পাশে ছিলেন কাশেম, যাঁকে তৃণমূলের অনেকেই ফুরফুরা থেকে নতুন মুখ তুলে আনার ‘কৌশল’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই হুগলিতেই এবার এই সম্মেলন হতে চলেছে। একে তিন দশকেরও বেশি সময় পরে এই সম্মেলন হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সামনে বিধানসভা ভোট। যে নির্বাচনে তৃণমূলের ‘বড় পুঁজি’ সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট। ফলে সে দিকেও সতর্ক নজর রাখতে হচ্ছে। পরিস্থিতিসাপেক্ষে স্বয়ং ডিজি-কে ময়দানে নামতে হয়েছে বলেই প্রশাসনের একাংশের ধারণা।
মাঠ পরিদর্শনের পরে রাজীব অবশ্য সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি। দাদপুরের একটি কলেজে পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের নিয়ে একটি বৈঠক করেছেন ডিজি। জেলা প্রশাসনেরও অনেকের বক্তব্য, এই অনুষ্ঠান পুলিশ এবং সামগ্রিক ভাবে প্রশাসনের কাছে ‘স্পর্শকাতর’। ভিড় সামাল দেওয়ার পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থা মসৃণ রাখার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। রাজ্য তো বটেই, দেশের বিভিন্ন রাজ্য এবং বিদেশ থেকেও মুসলিম সমাজের লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটবে এই সম্মেলনে। ফলে বাড়তি সতর্ক পুলিশ-প্রশাসন।