যেখান থেকে শুরু, সেখানেও পিছিয়ে।
সময়সীমা পেরিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা মাস কেটে গিয়েছে। ‘সবার শৌচাগার’ প্রকল্পে এখনও লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারল না নদিয়া। উল্টে কাজের গতি আরও শ্লথ হয়ে গিয়েছে। শৌচাগার তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থাগুলির দাবি, প্রশাসন থেকে সময়মতো টাকা না পাওয়ার কারণেই কাজ করতে পারছে না তারা।
২০১৩ সালের ২৫ জুলাই নদিয়া জেলায় স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার নির্মাণ অভিযান কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে ‘সবার শৌচাগার’ প্রকল্পটি গৃহীত হয়। পরে নদিয়াকে মডেল করে রাজ্যের অন্যত্রও এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এক-একটি বাড়িতে শৌচাগার নির্মাণের আনুমানিক খরচ ১০ হাজার টাকা ধরে ঠিক হয় একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ৪৫০০ ও নির্মল ভারত অভিযান ৪৬০০ টাকা তোলা হবে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ থেকে তিন জন দক্ষ ও নয় জন অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি বাবদ যাবে ২২৬৫ টাকা, বাকি টাকা শৌচাগার তৈরির কাঁচামাল কেনায় খরচ হবে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের বাকি ২২৩৫ টাকা ও নির্মল ভারত অভিযানের সম্পূর্ণ বরাদ্দ দিয়ে কেনা হবে শৌচাগার তৈরির কাঁচামাল ও সরঞ্জাম। বাকি ন’শো টাকা দিতে হবে উপভোক্তাকে। উপভোক্তা যদি টাকা দিতে না পারেন, তাহলে তিনি শৌচাগার নির্মাণে শ্রম দেবেন।
এই প্রকল্পে নদিয়ায় ১৭টি ব্লকে এক লক্ষ বাড়িতে চলতি বছর জানুয়ারি মাসের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত কংক্রিটের শৌচাগার তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। ৭০টি বেসরকারি সংস্থাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। কয়েকটি স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীও বরাত পায়। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এই সংস্থাগুলিকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পঞ্চায়েতের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে কাজ করার কথা ছিল সংস্থাগুলির। বেশ কিছু ব্লকে কাজ শুরুও হয়ে যায়। কিন্তু টাকা না পাওয়ায় অধিকাংশ জায়গায় কাজ আটকে গিয়েছে।
চলতি বছর ১৩ জানুয়ারি নদিয়া জেলা প্রশাসন একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যাচ্ছে অনেক ব্লকেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ এগোয়নি। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সমীক্ষায় উঠে এসেছে চাকদহ ব্লকের ছবিটা। চাকদহে ১৮,৫৩২টি পরিবারের শৌচাগার নেই। জেলা প্রশাসন স্থির করেছিল প্রাথমিক ভাবে ৮, ৯৯৫টি পরিবারে শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হবে। কিন্তু ১৩ জানুয়ারির মধ্যে ৬,০৭৭টি শৌচালয় তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। হাঁসখালি ব্লকের অবস্থা আরও করুণ। ওই ব্লকে ৫,৯৮৮টি পরিবারের শৌচাগার তৈরির কথা ছিল। মাত্র ১,৫০৭টি শৌচালয় তৈরি হয়েছে। শান্তিপুর ব্লকে ৫,৪৫৭টি শৌচাগারের মধ্যে তৈরি হয়েছে ২,৪২০টি। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার ৪৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।
শৌচাগার নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলির অভিযোগ, প্রাথমিক ভাবে যেটুকু কাজ হয়েছিল, জানুয়ারি মাসের পর থেকে তা আরও শ্লথ হয়ে গিয়েছে। এর মূল কারণ অর্থাভাব। শৌচাগার তৈরির জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলিকে একশো দিনের কাজের প্রকল্পের টাকা অগ্রিম দেয়নি প্রশাসন। কাজের আগে সংস্থাগুলিকে শুধু নির্মল ভারত অভিযানের ৬০ শতাংশ দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের জন্য। এতে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ ওই সব সংস্থার। হরিণঘাটা, হাঁসখালি, রানাঘাট-১ প্রভৃতি ব্লকের বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজের দায়িত্বে থাকা একটি সংস্থার কর্তা জানান, তাঁরা সময়মতো অর্থ পাচ্ছেন না। বিশেষত একশো দিনের কাজের প্রকল্পের টাকা মিলছে না। অন্য দিকে শৌচাগার তৈরির পর পঞ্চায়েত শংসাপত্র দিতে দেরি করছে। ফলে টাকা পেতে সমস্যা হচ্ছে। এদিকে ইট ভাটা, সিমেন্ট-বালি-লোহা-লক্কড়ের দোকানে ধারের বহর বাড়ছে। একই কথা জানালেন কালীগঞ্জ ব্লকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শৌচাগার নির্মাণকারী এক সংস্থার কর্তাও। তিনি বলেন, ‘‘লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচ করে প্রায় ১৩২৬টি শৌচাগার বানিয়েছি। কিন্তু এখনও অবধি অর্ধেকের বেশি শৌচাগারের টাকা মেলেনি। পঞ্চায়েতের প্রধানরা বলছেন, একশো দিনের কাজের টাকা নেই। আমাদের কাঁচামাল কেনার অর্থ পঞ্চায়েত দিচ্ছে না। কাজ শেষ হয়েছে এই মর্মে শংসাপত্রও দিচ্ছে না পঞ্চায়েত। ফলে ব্লক অফিস থেকে নির্মল ভারত অভিযানের বকেয়া ৪০ শতাংশ অর্থ মিলছে না। সমস্যার সমাধানে জেলাশাসকের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু সুরাহা হয়নি।” পলাশিপাড়ার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা গাঁটের কড়ি খরচ করে ৯ জন অদক্ষ শ্রমিককে পাওনা মিটিয়ে দিই কাজ শেষ হওয়ার পরই। পরে পঞ্চায়েত আমাদের পরিবর্তে ওই শ্রমিকের অ্যাকাউন্টেই মজুরির টাকা জমা করে। তখন শ্রমিকদের কাছে ঘুরে-ঘুরে সেই মজুরির টাকা সংগ্রহ করতে হয় আমাদের। এত নিয়মের বাঁধনে কাজ করা অসম্ভব।”
এদিকে গত আর্থিক বছরে নদিয়া জেলা একশো দিনের কাজ বাবদ কেন্দ্রের কাছ থেকে ১৫ কোটি টাকা পায়। সেই বকেয়ার ধাক্কা লাগছে সবার শৌচাগার প্রকল্পেও। কেবলমাত্র চাকদহ ব্লকেই শৌচাগার তৈরির জন্য একাধিক সংস্থার ৩০ লক্ষ টাকা বকেয়া রয়েছে। এই টাকা মেটানোর কথা একশো দিনের কাজের প্রকল্প থেকে। কিন্তু ব্লক অফিসে অর্থ নেই। নদিয়ার জেলাশাসক পিবি সালিম অবশ্য দাবি করলেন, শৌচাগার তৈরিতে নদিয়া অনেকটাই সফল। তবে তাঁর স্বীকারোক্তি, “কোথাও কোথাও একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কাঁচামাল কেনার অর্থ এখনও পায়নি সংস্থাগুলি। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত তা মিটিয়ে দিতে।”
কেন দেরি
• সরঞ্জাম কেনার অগ্রিম টাকা মিলছে না স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির।
• কাজ হয়ে গেলেও শংসাপত্র দিতে দেরি করছে পঞ্চায়েত।
• ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে মাটি কাটার কাজেই, শৌচাগারের জন্য কোনও টাকা থাকছে না পঞ্চায়েতে।
• টাকা বকেয়া থাকায় দোকান থেকে কাঁচা মাল মিলছে না।
• শংসাপত্রের অভাবে আটকে নির্মল ভারত অভিযানের টাকাও
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy