Advertisement
E-Paper

ফলক দিয়ে কী হবে, গুণবিচারী হতে চান দীনেশ

চন্দনপুকুরে ভাড়া-নেওয়া ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলছে। কোথায় থাকতে পারেন তিনি? উনি তো আমডাঙায়। জানা গেল স্থানীয় সূত্রে। কিন্তু আমডাঙায় তিনি তো নেই! স্থানীয় তৃণমূলের খবর, তিনি নাকি টিটাগড়ে। টিটাগড়ের তৃণমূল আবার জানাচ্ছে, ভাটপাড়ায় থাকার কথা। ভাটপাড়ার তৃণমূল বলছে, কই এ দিকে তো নেই!

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ০১:৪৮

চন্দনপুকুরে ভাড়া-নেওয়া ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলছে। কোথায় থাকতে পারেন তিনি? উনি তো আমডাঙায়। জানা গেল স্থানীয় সূত্রে।

কিন্তু আমডাঙায় তিনি তো নেই! স্থানীয় তৃণমূলের খবর, তিনি নাকি টিটাগড়ে। টিটাগড়ের তৃণমূল আবার জানাচ্ছে, ভাটপাড়ায় থাকার কথা। ভাটপাড়ার তৃণমূল বলছে, কই এ দিকে তো নেই!

গেছো দাদার গল্প মনে পড়িয়ে দেওয়া এই তত্ত্বতালাশ চলতে চলতে অবশেষে তাঁর খোঁজ মিলল নৈহাটিতে! দাদা নিজেই বলছেন, এই আছি। এই নেই। নানা জায়গায় ছুটে বেড়াতে হচ্ছে তো!

তা-ই বলে ব্যারাকপুরের তৃণমূল প্রার্থী এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কখন কোথায় প্রচারে থাকবেন, কেউ জানবে না? হাসছেন দীনেশ ত্রিবেদী। “আসলে আমি খুব নিচু তারে প্রচারটাকে বেঁধে রাখছি। মিডিয়ার ধারেকাছে যাচ্ছি না। গত বারও তা-ই করেছিলাম। এ বার আমার সঙ্গে আরও বেশি মানুষ আছেন।” সহাস্য ব্যাখ্যা প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর।

পাঁচ বছর আগে ভোটের সময়েও একই রকম অশরীরী ছিলেন প্রায়! কখন কোথায় কেউ জানত না! সংগঠনও তখন দুর্বল। তবু হাওয়ার জোরে তড়িৎ তোপদারের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতাকে ধরাশায়ী করে ছেড়েছিলেন। সেই যে জিতে গেলেন, পাঁচ বছরে বিশেষ তাঁকে ব্যারাকপুরে দেখাই গেল না! রেলমন্ত্রী হিসাবে লোকে তাঁর গুণের বিচার করল বটে, কিন্তু দর্শনধারী তিনি হলেন না! বিরোধীরা এই প্রচারের সুযোগ ছাড়বে কেন?

“এই হল মুশকিল! তোমাদের কাজ চাই, না আমাকে দেখা চাই?” পাল্টা জানতে চাইছেন গুজরাত-জাত দীনেশ। “রায়বরেলীতে সনিয়া গাঁধী, অমেঠিতে রাহুল গাঁধী, গাঁধীনগরে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে সব সময়

লোকে দেখতে পায় বুঝি?” সর্বভারতীয় তুলনা তুলে ধরছেন দীনেশ। আরও বলছেন, “তড়িৎবাবু এখানেই থাকেন, আড্ডা মারেন। ক্লাবে ক্লাবে ঘুরতেন। তা হলে তো উনি হারতেনই না!”

দেখা না হয় না-ই গেল। কাজ? লোকসভা কেন্দ্রের এ ধারে-ও ধারে সাংসদের নামসংবলিত ফলকও তো বিশেষ নেই। “এই তো ব্যারাকপুরের বার অ্যাসোসিয়েশনের লাইব্রেরি সংস্কারের কাজে একটা ফলক দেখলাম। আমিই ও সব লাগাতে বারণ করি। মানুষের টাকা মানুষ ফেরত পাচ্ছে। সাংসদের নাম খোদাই করে কী হবে?” আশ্চর্য। তিন বছরের শাসনে শিলান্যাসের ফলক বসানোয় কার্যত রেকর্ড করে ফেলা দলের সাংসদেরই দর্শন কি না বলছে, “শুধু প্রচার দিয়ে কিছু হয় না!”

দীনেশ আসলে এই রকমই। আটের দশকে রাজীব গাঁধীর সময় থেকে রাজনীতিতে লড়ছেন একটাই মন্ত্র নিয়ে। পরিচ্ছন্ন লোকজন যত বেশি আসবেন, রাজনীতিটা তত পরিচ্ছন্ন হবে। তৃণমূলের মতো নেত্রী-সর্বস্ব দলে এসেও নিজের স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছেন। নৈহাটির অফিস-ফেরতা কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, “সাংসদ হওয়ার পরে ওঁকে এখানে দেখেছি বলে মনে পড়ে না! তবু পাঁচ জন রাজনৈতিক নেতার মতো তোলাবাজি, দুষ্কৃতীদের নিয়ে ওঠাবসার অভিযোগ ওঁর বিরুদ্ধে করা যাবে না। অল্প দিন রেলমন্ত্রী হয়ে রেলের ভালর জন্যই ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দল তাঁর চাকরিটাই রাখল না!”

এই প্রসঙ্গ তুললে বিতর্ক এড়াতেই এখনও পছন্দ করেন দীনেশ। বলতে চান, “প্রত্যেকটা দলের একটা নীতি থাকে। আমার দলও তার নীতি মেনে কাজ করেছিল। আমি কিন্তু তখন দলের বিরুদ্ধে একটা বাক্যও বলিনি!” তাঁর নীতি কী? “মানুষের অধিকারকে সম্মান দেওয়া। আজ আমি মিছিলে বেরোলে লোকে এগিয়ে এসে রাস্তার কথা, জলের কথা জানতে চাইতে পারে। এই গণতান্ত্রিক অধিকার তারা পেয়েছে। গুন্ডাগর্দির মধ্যে আমি নেই!” সাফ কথা দীনেশের।

গুন্ডামির কথা এলে নিজের বাঁ হাতটা তুলে দেখান সম্রাট তপাদার। জগদ্দল বিধানসভা এলাকায় প্রচার সেরে ফেরার পথে কংগ্রেস প্রার্থীর যে হাত জখম করে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। সম্রাটের প্রশ্ন, “দুষ্কৃতীদের গায়ে তৃণমূল বা সিপিএম কিছু লেখা থাকে না। কিন্তু লোকসভা ভোটে এক জন প্রার্থীর যদি এই অবস্থা হয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?” ব্যারাকপুরের বাসিন্দা, আইনজীবী সম্রাট এলাকায় কংগ্রেসের কর্মসূচিতে পরিচিত মুখ। সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ‘বাইরের লোক বাইরে থাক, ঘরের ছেলে দিল্লি যাক’ কংগ্রেসের এই আবেদন ছড়িয়ে পড়েছে ভালই। “ওই জন্যই মারটা পড়েছে আমার উপরে,” অনুভব করছেন সম্রাট।

সম্রাট যেমন দুষ্কৃতীদের হাতে, তাঁর এক প্রতিদ্বন্দ্বী আবার মার খেয়েছেন ভাগ্যের হাতে। স্ত্রীর অসুস্থতা সামলে চাপের মধ্যেই প্রচারে নেমেছিলেন রুমেশ কুমার হান্ডা। কিন্তু কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনা তাঁকে কাহিল করে ছেড়েছে। তবু প্রচারে বেরোতেই হচ্ছে। গাড়িতে বসেই যতটুকু বলার বলছেন। ব্যারাকপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলেন বলে এলাকা তাঁর অনেকটাই চেনা। তার উপরে এই কেন্দ্রের হিন্দিভাষী ভোটারদের অধিকাংশ খোলাখুলিই জানাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদীর জন্য তাঁদের সমর্থনের কথা। সেই হাওয়ার গন্ধে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি রাজনাথ সিংহ পর্যন্ত ঘুরে গিয়েছেন। দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েও বিজেপি প্রার্থী হান্ডা তাই বলতে পারছেন, “সব জায়গায় যদি যেতে না-ও পারি, লোকে আমাদের দিকে আছে।”

শ্যামনগরে বিবেকানন্দ গড়ের বাঙালি আস্তানা থেকে সুভাষিণী আলি যখন বেরোচ্ছেন, তাঁর সঙ্গেও বিস্তর লোক। কানপুর থেকে গোটাতিনেক স্যুটকেস নিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেস চেপে শিয়ালদহে এসে যে দিন নেমেছিলেন, সে দিন তিনি বাংলার ভোট-যুদ্ধে নেহাতই বহিরাগত। কিন্তু দু’মাসে ব্যারাকপুর কেন্দ্রের প্রতিটি কোণা ছুঁয়ে ফেলেছেন প্রয়াত প্রেম ও লক্ষ্মী সহগলের কন্যা। শিল্পাঞ্চলের এই তল্লাটে সিপিএম প্রার্থী বলতেই যে দাপুটে মুখ বোঝাত, সুভাষিণী তার থেকে একেবারেই আলাদা। সদাহাস্যময় এই প্রৌঢ়াকে পেয়ে আমডাঙার মহিলারা দুঃখের ঝাঁপি উপুড় করে দিচ্ছেন, ভাটপাড়ায় বাড়ির বারান্দা থেকে এগিয়ে আসছে একের পর হাত। লোকাল ট্রেনে উঠে পড়ছেন, মিছিলের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে-পড়া অটোর ভিতরে মুখ বাড়িয়ে দিচ্ছেন। জনতা পুলকিত হচ্ছে।

নারী নির্যাতনের বৃত্তান্ত অবধারিত ভাবেই সুভাষিণীর প্রচারের তুরুপের তাস। সেই সঙ্গেই তাঁর প্রশ্ন, কিছু দিন দীনেশ এবং তার পরে কাঁচরাপাড়ার ভূমিপুত্র মুকুল রায় রেলমন্ত্রী ছিলেন। তাঁদের প্রতিশ্রুতির কী হল? সুভাষিণীর কথায়, “কাঁচরাপাড়ায় রেলের কারখানার একটা ইটও গাঁথা হয়নি। পুরনো কাঠামো ভেঙে খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে যে সব সাপ বেরিয়েছে, সেগুলো পর্যন্ত বেচে দিচ্ছে!” অভিযোগ সম্পর্কে দীনেশ ওয়াকিবহাল। তাই তাঁকে বলতে হচ্ছে, “কাঁচরাপাড়া আর শ্যামনগরে কারখানা, কল্যাণী পর্যন্ত মেট্রো এগুলো হবেই। এ বার যে দলের যিনিই রেলমন্ত্রী হোন, আমি তাঁর ঘাড়ে চেপে সব আদায় করে আনব!”

আপাতত বিরোধীদের অবশ্য চিন্তা বীজপুর, আমডাঙা, ভাটপাড়ায় সুষ্ঠু ভোটের জন্য কমিশনের কাছে আশ্বাস আদায়। দু-একটা ওয়ার্ডের সামান্য উপনির্বাচনে পর্যন্ত বুথ জ্যাম দেখতে অভ্যস্ত বিরোধীরা আশঙ্কায় আছেন গোলমালের। আর খোদ দীনেশ বলছেন, “আমার কোনও অসুবিধা নেই। সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি আমি!”

শাসক দলের সাংসদ কি না কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইছেন! কেমন যেন শোনাচ্ছে না? কোথাও কোনও সংশয় আছে নাকি? এক ডাকসাইটে তৃণমূল বিধায়কের জবাব, “চতুর্মুখী লড়াই। দেখা যাক না, কী হয়!”

বন্ধ কারখানার বন্ধ্যা ভূমিতে পাক খাচ্ছে রহস্যের হাওয়া!


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

sandipan chakrabarty dinesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy