বোরখার আড়াল থেকে শোনা যাচ্ছে পুরুষকণ্ঠের শাসানি।
রাতে ফের বাইক-বাহিনীর টহল।
এ বারও কি বুথে আতরের গন্ধ পাওয়া যাবে?
রাজ্যে সিপিএম গিয়ে তৃণমূূল এসেছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে চাপা সন্ত্রাসের ছবিটা একই রকম রয়ে গিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-ভাঙড় এলাকায়। এক সময়ে যে অভিযোগ উঠত বামেদের বিরুদ্ধে, এখন তা শোনা যাচ্ছে বর্তমান শাসকদল সম্পর্কে। গত কয়েক দিন ধরে গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত, যদি মার খেতে হয়! ফলে কাল, সোমবার ক’জন বুথমুখো হবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
দু’টি এলাকা পাশাপাশি হলেও লোকসভা কেন্দ্র আলাদা। ক্যানিং-পূর্ব এলাকাটি পড়ছে জয়নগর কেন্দ্রের আওতায়। ভাঙড় যাদবপুরে। ভাঙড়ের পূর্ব কাঁঠালিয়া, ভোমরু, রঘুনাথপুর, জামিরগাছি, নয়দাপাড়া বা ক্যানিং-পূর্বের মৌখালি, আরাবাঁকি সবই ছোট-ছোট গ্রাম। গরিবগুরবো মানুষগুলোর জীবিকা বলতে চাষাবাদ বা দিনমজুরি। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার ভোটার। কিন্তু চাপা সন্ত্রাসের কারণে এঁদের অধিকাংশই ভোট নিয়ে উৎসাহী নন।
সেই ‘চাপা সন্ত্রাস’ ঠিক কী রকম?
দিন দুয়েক আগে ভাঙড়ের এক গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, একটি বাড়ির সামনে ধান ঝাড়ছেন কয়েক জন মজুর। ভোট দিতে যাবেন? কারও মুখে রা নেই। কয়েক বার জিজ্ঞাসার পরে ধানের গাদার উপর থেকে পাল্টা এল “মারলে আপনি বাঁচাবেন? বুথে গেলে এমন তাড়া দেবে, পালিয়ে পথ পাব না। বছর পাঁচেক আগে সাহস করে এক বার গিয়েছিলাম। তার পরে সাত দিন যেখানেই দেখেছে, তাড়া করেছে।”
আর এক মজুর বললেন, “এখনই রাতে মোটরবাইক টহল দিচ্ছে। বাড়ির সামনে এসে বলে যাচ্ছে, ভোটের দিন বাড়িতে ভাল খাওয়ার ব্যবস্থা করো। ভোট আমরা দিয়ে দেব। গরমে কষ্ট করতে হবে না।” ক্যানিংয়ের মৌখালি গ্রামের এক প্রৌঢ় জানালেন, ভোটার-কার্ড থাকলেও তিনি কখনও ভোট দেননি। এ বারও দেওয়ার ইচ্ছা নেই। কেন? তাঁর কথায়, “গ্রামের রাস্তায় বোরখা পরা পুরুষদের আনাগোনা বেড়েছে। অনেক সময়ে পুলিশের সামনে-পিছনেও থাকছে ওরা। পুলিশকে আমরা কিছু বলছি কি না, নজর রাখছে। পুলিশ চলে যাওয়ার পর শুরু হচ্ছে শাসানি। এর পরে আর ভোট দেওয়ার ইচ্ছা থাকে?”
এক প্রাক্তন পুলিশকর্তার মতে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজর এড়ানোর জন্যই ওই বোরখা। বছর দশেক আগে ভোট দিতে গিয়ে বোরখা পরা পুরুষকন্ঠে কান দেননি ভাঙড়ের পোলেরহাট এলাকার এক হাতুড়ে। ফলও ভুগতে হয়েছিল। তাঁর কথায়, “নিজের পছন্দ মতো ভোট দেওয়ায় বুথ থেকে কিছুটা আসার পরেই আমায় বেদম মারা হয়। ৩০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিল। চার মাস বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করতে হয়েছিল। তার পর থেকে আর ভোট দিইনি। এ বারও ভয়ে আছি।”
ক্যানিংয়ের আঠারোবাঁকি গ্রামের এক বৃদ্ধ জীবনে প্রথম ভোট দেন ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। বুথে ঢুকে সুঘ্রাণ পেয়ে ভেবেছিলেন, পুলিশ আতর ছড়িয়েছে। কিন্তু বুথ থেকে বেরোতেই তাঁর ঘোর কাটে। তাঁর কথায়, “সিপিএম নিজেদেরটা ছাড়া ইভিএমের বাকি সব বোতামে আতর মাখিয়ে রেখেছিল। সেই গন্ধ আঙুলে লেগে গিয়েছিল। বেরোতেই কয়েক জন আমার আঙুলের গন্ধ শুঁকে বেদম মারল। চাষ করা বন্ধ করে দিল। কে যাবে বলুন ভোট দিতে? আবার যদি এমন হয়!”
বছরের পর বছর কেন ছবিটা বদলায় না?
বাম আমলে ক্যানিং এলাকায় সিপিএমের ‘ভোট ম্যানেজার’ ছিলেন সওকত মোল্লা। তাঁর দাপটে কেউ নিজের পছন্দমাফিক ভোট দিতে পারত না বলে সেই সময়ে অভিযোগ তুলত তৃণমূল। পালাবদলের পরে সেই সওকত বহু অনুগামী নিয়ে এখন তৃণমূলে। এখন তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের একই অভিযোগ তুলছে বামেরা। যে অভিযোগটা ভাঙড়ে উঠছে তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধেও।
সিপিএমের ভারপ্রাপ্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “ক্যানিং-ভাঙড়ে তৃণমূল আমাদের পোলিং এজেন্টদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শাসাচ্ছে। এলাকাকেও সন্ত্রস্ত করে রেখেছে।” সওকত এবং আরাবুল অবশ্য ভীতি-প্রদর্শনের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। দু’জনেরই দাবি, “কোথাও কোনও গোলমাল, শাসানি নেই। মানুষ স্বতঃস্ফূতর্র্ ভাবে ভোট দেবেন।”
ওই দুই এলাকায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসন কী করছে?
জেলা প্রশাসনের দাবি, হুমকি বা ভয় দেখানোর কিছু অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। তার ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে দু’কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী দুই এলাকাতেই টহল শুরু করেছে। ভাঙড়ে মোট বুথের সংখ্যা ২৬৫টি। ক্যানিংয়ে ২২৫টি। দুই জায়গাতেই ৯০ শতাংশ বুথকে ‘অতি স্পর্শকাতর’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তৃতীয় এবং চতুর্থ দফাতেও অভয় দিয়েছিল প্রশাসন তথা নির্বাচন কমিশন। তার পরেও রিগিং-মারধরের ঘটনা বাদ যায়নি। ক্যানিং-ভাঙড়ের মানুষ নিশ্চিন্ত হবেন কী করে? প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy