নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই বন্ধ হয়ে যায় ওয়েস্ট বেঙ্গল কো-অপারেটিভ স্পিনিং মিল। —নিজস্ব চিত্র।
বাম আমল থেকেই ধুঁকছিল সুতোকল। ২০১১ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকেরা আন্দোলন-অবরোধ করেছেন, সরকারি আশ্বাসও মিলেছে। কিন্তু কল কবে খুলবে, তা এখনও অনিশ্চিত।
বিভিন্ন জেলায় রাজ্য সরকারের পরিচালনাধীন বেশ কয়েকটি সুতোকল আছে। চারটি বর্তমানে বন্ধ। তারই অন্যতম শ্রীরামপুরে দিল্লি রোড লাগোয়া ওয়েস্ট বেঙ্গল কো-অপারেটিভ স্পিনিং মিল। বহু আগে এক বার বন্ধ হলেও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তা ফের চালু হয়। সেই থেকে একটানা বেশ রমরমিয়েই চলছিল। বাম আমলের শেষ দিক থেকে বিভিন্ন কারণে মিলটি রুগ্ণ হতে শুরু করে।
শ্রমিকদের একাংশের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের অদক্ষতার কারণে এবং তৎকালীন সরকার ঠিক মতো নজর না দেওয়াতেই লোকসান হতে থাকে। পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে চাহিদা এবং গুণমানের ভারসাম্যও রক্ষা করা যায়নি। ২০১১ সালে তৃণমূল যখন সরকারে আসে, তখন মিলের দেনা কয়েক কোটি টাকা। তার মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি টাকা পাওনা ছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা কটন কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার। বিদ্যুৎ বিল-সহ বিভিন্ন খাতেও প্রচুর বকেয়া পড়ে যায়। বাকি পড়ে ছিল কাঁচামাল সরবরাহকারীদের টাকা। এই পরিস্থিতিতে ২ জুলাই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
সেই সময়ে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে সুতোকলটিতে প্রায় সাড়ে পাঁচশো শ্রমিক কাজ করতেন। উৎপাদন চালু এবং বকেয়া মেটানোর দাবিতে তাঁরা আন্দোলনে নামেন। সরকারি হস্তক্ষেপ চেয়ে দিল্লি রোড অবরোধও করে শ্রমিক সংগঠনগুলি। চাপে পড়ে রাজ্য সরকার কারখানা পুনরুজ্জীবনের আশ্বাস দিয়েছে। উৎপাদন ফের চালু হবে, এই আশায় এখনও বসে রয়েছেন শ’পাঁচেক শ্রমিক। তাঁদের অভিযোগ, ন’মাসের বেতন বকেয়া পড়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে ট্রান্সফর্মার বিকল হয়ে যাওয়ায় কারখানা চত্বর বিদ্যুৎহীন। চুরি আটকাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারেই বসে থাকতে হচ্ছে পাহারাদারদের। কারখানার শেডও জীর্ণ হয়ে পড়েছে।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, উৎপাদন এখনই চালু করতে না পারলেও বকেয়া মেটানোর ব্যাপারে সরকার চেষ্টার ত্রুটি করছে না। ২০১৩-র অগস্ট পর্যন্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্র্যাচুইটির টাকা যতটা সম্ভব মেটানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিলও অনেকটাই মেটানো হয়েছে। চলতি অর্থবর্ষে বাজেটে রাজ্যের পরিকল্পনা-বহির্ভূত বরাদ্দ (যে খাতে বেতন দেওয়া হয়) থেকে সুতোকলটির জন্য ১০ কোটি ১৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ২ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছে কারখানার তরফে। যা পেলে আরও কয়েক মাসের বেতন মেটানো সম্ভব হবে। কারখানা সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত ডিসেম্বরে রাজ্যের পরিকল্পনা বরাদ্দ থেকেও ২৫ লক্ষ টাকা এসেছে। তা এখনও খরচ হয়নি। শ্রীরামপুর ছাড়াও কল্যাণী এবং দিনাজপুরের বন্ধ সুতোকলের পুনরুজ্জীবনের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সুতোকলের তৃণমূল প্রভাবিত আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অমল রায়ের বক্তব্য, ‘‘সরকার বকেয়া মেটাচ্ছে। আশা করছি, অচিরে উৎপাদনও শুরু হবে।” বিরোধী শিবির অবশ্য সমালোচনা করতে ছাড়ছে না। কংগ্রেসের হুগলি জেলা নেতা দিলীপ নাথ পাল্টা বলেন, “ওরা শুধু মুখে বড়-বড় বুলি আওড়াচ্ছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। শ্রমিকরা সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছেন।” কারখানার সিটু অনুমোদিত ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ বিশ্বাসের আক্ষেপ, “যন্ত্রপাতি থেকে শেড সব কিছুই পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারখানা ঠিক মতো চালাতে যে লগ্নি দরকার, তা কোথা থেকে আসবে সেটা আগে স্পষ্ট করে বলা হোক। শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে তো সরকার কোনও আলোচনাই করে না।”
শ্রীরামপুরের তৃণমূল বিধায়ক সুদীপ্ত রায় অবশ্য জোর দিয়ে বলছেন, “উৎপাদন চালুর ব্যাপারে সরকার সদর্থক চিন্তাভাবনা করছে। কলটির আধুনিকীকরণও জরুরি। সেই চেষ্টাও চলছে। সরকার আগ্রহী বলেই তো শ্রমিকদের বকেয়া এবং অন্য খরচ মেটানো হচ্ছে।”
সুতোকলের পরিচালন কমিটির চেয়ারম্যান, ব্যারাকপুরের তৃণমূল বিধায়ক শীলভদ্র দত্তও বলেন, “সমবায়ের মাধ্যমে চললেও কী ভাবে ওই সুতোকলের পুনরুজ্জীবন সম্ভব, সরকার তা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। আশা করছি, দ্রুত উপযুক্ত পদক্ষেপ করা যাবে।”
শ্রমিকেরা কেউ আশা আঁকড়ে আছেন, কেউ হতাশ। আড়ালে সকলেরই এক কথা কর্তাদের আশ্বাস দিচ্ছেন ভাল, তবে না আঁচালে বিশ্বাস নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy