Advertisement
E-Paper

সহায় ভালবাসা, জমি ফেরানোর আশায় ছুটছেন রিঙ্কু

ঝাঁ ঝাঁ রোদের তাপে মাটিতে পা রাখাই দায়। তিনি কিন্তু নির্বিকার। দলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ওই রোদের মধ্যেই চক্কর কাটছেন। আজ মগরাহাট তো কাল মন্দিরবাজার, পরশু আবার পাথরপ্রতিমা। আজ বিকেলে কালিকাপোতা, পদ্মেরহাটে গ্রাম পরিক্রমা তো কাল সন্ধ্যায় নিশ্চিন্তপুরের কাছে পথসভা। অসুবিধা হচ্ছে না এত গরমে? “একেবারেই না। আমি তো সুন্দরবনের মেয়ে। অভ্যাস আছে।” কাকদ্বীপ বাজারের তস্য গলির মধ্যে পার্টি অফিস। তারই দোতলায় বসে হাসতে হাসতে বললেন রিঙ্কু নস্কর। বয়স এখনও তিরিশ ছোঁয়নি। গায়ে আটপৌরে একটা শাড়ি, চোখে চশমা। মুখে হাসি লেগেই রয়েছে। কে বলবে, শ্যামলা রঙের এই মেয়েটিকে ঘিরেই পাঁচ বছর আগে হাতছাড়া হওয়া মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্র পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছে সিপিএম।

দিব্যেন্দু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৪ ০১:৫৪

ঝাঁ ঝাঁ রোদের তাপে মাটিতে পা রাখাই দায়। তিনি কিন্তু নির্বিকার। দলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ওই রোদের মধ্যেই চক্কর কাটছেন। আজ মগরাহাট তো কাল মন্দিরবাজার, পরশু আবার পাথরপ্রতিমা। আজ বিকেলে কালিকাপোতা, পদ্মেরহাটে গ্রাম পরিক্রমা তো কাল সন্ধ্যায় নিশ্চিন্তপুরের কাছে পথসভা।

অসুবিধা হচ্ছে না এত গরমে? “একেবারেই না। আমি তো সুন্দরবনের মেয়ে। অভ্যাস আছে।” কাকদ্বীপ বাজারের তস্য গলির মধ্যে পার্টি অফিস। তারই দোতলায় বসে হাসতে হাসতে বললেন রিঙ্কু নস্কর। বয়স এখনও তিরিশ ছোঁয়নি। গায়ে আটপৌরে একটা শাড়ি, চোখে চশমা। মুখে হাসি লেগেই রয়েছে। কে বলবে, শ্যামলা রঙের এই মেয়েটিকে ঘিরেই পাঁচ বছর আগে হাতছাড়া হওয়া মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্র পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছে সিপিএম।

আসলে স্বপ্ন দেখাচ্ছে মূলত দু’টো ফ্যাক্টর। যার প্রথমটা অবশ্যই রিঙ্কু নিজে। ক্যানিং-এর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পড়াশুনো করতে প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে বাম রাজনীতি। প্রথমে কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর। তার পর সরাসরি লোকসভার ময়দানে। কম বয়স, ঘরের মেয়ে ভাবমূর্তি আর মধুর ব্যবহারই যে রিঙ্কুর সবচেয়ে বড় অস্ত্র, তা মেনে নিচ্ছেন তাঁর বিরোধী দলের নেতারাও। রিঙ্কুকে ঘিরে বিশেষত মহিলা এবং কম বয়সীদের ভিড় দেখে উৎসাহিত সিপিএম নেতারা বলছেন, “আমাদের প্রার্থীর মিছিলে বা প্রচারে এমন অনেক ছেলেমেয়ে নামছেন, যাঁরা সরাসরি আমাদের দলের সঙ্গে যুক্ত নন। এটা আমাদের বড় লাভ।”

আর দ্বিতীয় ফ্যাক্টরটা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী। গত বিধানসভা নির্বাচনে রায়দিঘি কেন্দ্রে দেবশ্রী রায়ের কাছে হারের পরেও এলাকা ছেড়ে চলে যাননি। মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন বছরভর। তার সঙ্গে নিজস্ব কায়দায় জনসংযোগ। সুফলও মিলেছে গত পঞ্চায়েত ভোটে। রায়দিঘি-সহ সংলগ্ন এলাকায় জমি অনেকটাই ফিরে পেয়েছে সিপিএম। রিঙ্কুকে এখানে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোর মূল কান্ডারি কান্তিবাবুই। আসলে লড়াইটা তো তাঁর নিজেরও। রিঙ্কুকে জেতানোর যাবতীয় দায়ভার তাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কখনও প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে, কখনও নিজের মতো করে প্রচার চালাচ্ছেন। কোনও বড় সভা নয়। ছোট ছোট ঘরোয়া বৈঠক, পথসভা আর ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়েই প্রচার চালাচ্ছে সিপিএম।

রিঙ্কুর জয় নিয়ে আশাবাদী কান্তিবাবুর কথায়, “শহর থেকে তারকাদের ধরে এনে প্রার্থী করার যে ধারা চলছে, তার বিরুদ্ধে রিঙ্কু একটা প্রতিবাদ বলতে পারেন। আমরা যে শ্রেণির জন্য লড়াইয়ের কথা বলি, ও তাদেরই ঘরের মেয়ে। ফলে গ্রামে ঢুকে মানুষের কাছে পৌঁছতে ওর অসুবিধা হচ্ছে না। দেখবেন, এখানকার মানুষ ওকে ফেরাবেন না।”

জয়ের আশা দেখলেও লড়াইটা যে কঠিন, তা বিলক্ষণ জানেন কান্তিবাবুরা। কয়েক বছর আগেও লালদুর্গ মথুরাপুর এখন তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি। অঙ্কের হিসেবে সাতটি বিধানসভাই তৃণমূলের দখলে। পঞ্চায়েতেও রায়দিঘি এবং কিছু এলাকা বাদ দিলে সিংহভাগ তাদেরই দখলে। কিন্তু সেই অঙ্কই বলছে, ২০০৯ সালের লোকসভায় এখানে তৃণমূলের প্রার্থী চৌধুরী মোহন জাটুয়া জিতেছিলেন ১ লক্ষ ৩০ হাজার ভোটে। ২০১১-র বিধানসভায় তৃণমূল সাতটি কেন্দ্রে জিতলেও ব্যবধান নেমে আসে ৮০ হাজারে। আর গত বছর পঞ্চায়েতের হিসেবে সিপিএম পিছিয়ে ৩০ হাজার ভোটে। সিপিএমের অঙ্ক, সন্ত্রাস আটকানো গেলে এবং মন্দিরবাজার, কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা, মগরাহাটের সব বুথে এজেন্ট দিতে পারলে জেতা কঠিন নয়।

কিন্তু সে অঙ্ক মিলবে কি? “কেন নয়? গত পাঁচ বছরে সাংসদ হিসেবে জাটুয়া এখানে কী করেছেন? বাঁধ থেকে রেললাইন কোনও কাজ এক ইঞ্চিও হয়নি। এখানকার মানুষ ভুলে যাবেন সেগুলো?” কান্তিবাবু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাঁধের জন্য কেন্দ্রের দেওয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। সিপিএমের বাড়তি অস্ত্র সারদা-টেট নিয়ে দুর্নীতি। এমনকী জাটুয়া নিজেও অস্ত্র সিপিএমের প্রচারে! “বাঁধ বা রেললাইনের কাজ ছেড়ে দিন, আয়লায় ত্রাণের টাকা আটকাতে সাংসদ হয়েও উনি কী করেছিলেন, তা মনে আছে এখানকার লোকের,” বলছেন কান্তি।

যা শুনে হাসছেন জাটুয়া। প্রাক্তন এই পুলিশ কর্তার কথায়, “সিপিএম তো মিথ্যে ছাড়া বলতেই পারে না! সাংসদ কোটার টাকা খরচ করে সাগরে ফ্লাড রেসকিউ সেন্টার, অল ওয়েদার জেটি (নদীতে ভাটার সময়েও লঞ্চে যাতায়াতের সুবিধার জন্য) কালনাগিনী নদীর উপর সেতু, পাথরপ্রতিমায় হাসপাতালের সামনে রোগীদের বাড়ির লোকের থাকার জন্য পাকা জায়গা করে দেওয়া, অ্যাম্বুল্যান্স, জাতীয় সড়কের উন্নয়ন এগুলো কি ওরা করেছে?” সেই সঙ্গেই কটাক্ষ, “ওরা যদি কাজ করতো, তা হলে এ ভাবে সর্বত্র হারতে হতো না!”

সাংসদ হিসেবে জল, জাতীয় সড়কের হাল ফেরানোর মতো কিছু কাজ জাটুয়া করেছেন গত পাঁচ বছরে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও তো কম ওঠেনি। “আসলে মমতাদির উন্নয়নের সামনে বিরোধীরা খেই হারিয়ে ফেলেছে! কিছু তো বলতে হবে। তাই মিথ্যে প্রচার চালাচ্ছে!” পাল্টা জবাব সত্তরোর্ধ জাটুয়ার। সেই সঙ্গেই মন্তব্য, “গত লোকসভায় এখানে এক লক্ষ তিরিশ হাজার ভোটে জিতেছিলাম। উন্নয়নের অস্ত্রে এ বারে ওটাকে দু’লক্ষ করার লড়াই আমার।”

বলছেন বটে, হবে কি? জাটুয়ার দলের নেতা-কর্মীদেরই অনেকে সংশয়ে। প্রাক্তন সাংসদকে এলাকায় সে ভাবে দেখতে না পাওয়া বা তাঁর ব্যবহার নিয়ে একাংশের ক্ষোভ তো আছেই। তার সঙ্গে জয়নগর-রায়দিঘি রেললাইন না হওয়া, আয়লায় বিধ্বস্ত বাঁধ সারাই না হওয়ার মতো বিষয়গুলোও আছে। এ সব নিয়ে এলাকায় ক্ষোভ প্রচারে নেমে টের পাচ্ছেন তৃণমূলের নেতারা। তাই দেব বা মিঠুনকে দিয়ে সভা করালেও তাতে ভিড়ের বহর দেখে ভাঁজ পড়েছে নেতাদের অনেকের কপালে। এ সবের সঙ্গে যোগ হয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। কারও ক্ষোভ টিকিট না পাওয়া, কারও আবার দলে গুরুত্ব কমে যাওয়া। যদিও প্রকাশ্যে তা নিয়ে মুখ খুলতে পারছেন না কেউই। বিতাড়িত হওয়ার ভয়!

সিপিএমের পোড় খাওয়া নেতারা অবশ্য এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছেন না। কারণ আগেও তাঁরা দেখেছেন, ভোটযন্ত্রে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রভাব পড়তে দেন না তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা! মগরাহাটে সিপিএমের এক নেতার কথায়, “আমাদের আসল ভয় সন্ত্রাস। এখনও বহু কর্মী ঘরছাড়া।” যা শুনে জাটুয়া বলছেন, “কেউ ঘরছাড়া নয়। সিপিএমের কিছু ক্রিমিনাল এলাকায় ফিরতে পারছেন না বলেই ওদের নেতাদের এত চিন্তা! ওই সব অপরাধীরা পুলিশের ভয়ে ঘরছাড়া।”

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

সন্ত্রাসের পাশাপাশি সিপিএমের অনেক নেতা স্বীকার করছেন, তাঁদের ভয় এ বার বিজেপিও। প্রকাশ্যে অবশ্য কেউই এ নিয়ে সরাসরি মুখ খুলছেন না। মোদী হাওয়ায় বিজেপি যে এখানে ভালই ভোট কাটবে, তা স্পষ্ট সব দলের কাছেই। বিজেপির প্রার্থী তপন নস্কর বয়সে তরুণ। এলাকা জুড়ে ছুটছেনও প্রচুর। মোদী-নামেই জয়ের ভরসা তাঁর। মিটিং-মিছিলে ভিড়টাও নেহাত মন্দ হচ্ছে না। তপন নিজেও চমক দেওয়ার আশা করছেন। বিদায়ী সাংসদ যদিও বলছেন, “বিজেপি গত বার এখানে ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এ বারে তা-ও পাবে না!” কিন্তু সিপিএমের এক নেতার কথায়, “বিজেপি গত বারের তুলনায় অনেকটাই বেশি ভোট পাবে। তবে কাদের ভোটে ওরা ভাগ বসাবে, তা বলা কঠিন। বিজেপির ভোট কাটাকাটির উপরে অনেক অঙ্ক নির্ভর করছে।”

লড়াইয়ের ময়দানে প্রবল ভাবে না থেকেও আছেন কংগ্রেসের মনোরঞ্জন হালদার। বিজেপিকে নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নন ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা হাওয়ায় জয়ী মনোরঞ্জনবাবু। সুভদ্র মানুষ। তাঁর আশা, কংগ্রেসের নিজস্ব যে ভোটব্যাঙ্কের পুরোটাই তাঁর ঝুলিতে আসবে। তার সঙ্গে যদি ‘ফ্লোটিং ভোট’টা আরও একটু বাড়ানো যায়...!

সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল? রিঙ্কুর নিজের কথায়, “অতশত বুঝি না। গ্রামগুলোতে যাচ্ছি। প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। কত মানুষ আশীর্বাদ করছেন, ভাবতে পারবেন না। মহিলারা গায়ে-মাথায় হাত দিয়ে বলছেন, তুমিই জিতবে! এত লোকের আশ্বাস-স্নেহ-ভালবাসা পাচ্ছি...।”

এই আশ্বাস-স্নেহ-ভালবাসাটাই পাথেয় রিঙ্কুর।

mathurapur dibyendu chakrabarty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy