Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Dilip Ghosh

সব বিতর্ক ঠেলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবার রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ

বুধবার বিকেলের মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, আবার সভাপতি হচ্ছেন দিলীপই|

ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষকে। নিজস্ব চিত্র

ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষকে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব স‌ংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২০ ১৩:৪৮
Share: Save:

দ্বিতীয় বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি নির্বাচিত হলেন দিলীপ ঘোষ। রাজ্য সভাপতি নির্বাচনের জন্য আজ সকাল ১১টা থেকে রাজ্য বিজেপির বৈঠক বসেছিল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পাঠানো প্রতিনিধি তথা সাংগঠনিক নির্বাচনের জন্য এ রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসার মুরলীধর রাও সেই বৈঠকেই ঘোষণা করলেন যে, আবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন দিলীপ ঘোষই।

আজ সকালের বৈঠকে অবশ্য শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটাই বাকি ছিল। আসলে বুধবার বিকেলের মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, আবার সভাপতি হচ্ছেন দিলীপই। কারণ দিলীপ ঘোষ ছাড়া আর কেউ মনোনয়নপত্রই জমা দেননি সভাপতি পদের জন্য। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাননি। দিলীপই ফের সভাপতি হন, এই বার্তাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল দিল্লি থেকে। তাই দিলীপ ঘোষকে দিয়ে মনোনয়ন পত্রে সই করিয়ে তা সঙ্গে নিয়ে বুধবারই দিল্লি চলে যান নির্বাচন পর্যবেক্ষক কিরেন রিজিজু| তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আজ সকালে দিলীপের নামই ঘোষিত হবে|

২০১৫-র সেপ্টেম্বরে রাজ্য বিজেপির সভাপতি হন দিলীপ ঘোষ। সেই মেয়াদ শেষ হয় ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে। কিন্তু তার মাস ছয়েকের মধ্যেই ছিল লোকসভা নির্বাচন। তাই সে সময়ে নতুন সভাপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় না গিয়ে দিলীপের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তত দিনের গোটা দেশেই সাংগঠনিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় বিজেপি। সেই প্রক্রিয়া এখন প্রায় শেষ পথে। রাজ্য স্তরের সাংগঠনিক নির্বাচনের ফল আজই ঘোষিত হয়ে গেল। আবার রাজ্য সভাপতি পদে বসলেন দিলীপ ঘোষ।

সভাপতি পদে প্রথম তিন বছর পূর্ণ করার পরেও এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া দিলীপের পক্ষে যতটা সহজ হয়েছিল, এ বার কিন্তু পরিস্থিতি ততটা মসৃণ ছিল না। গত চার বছরে নানা সময়ে দিলীপ ঘোষের নানা গরমা-গরম মন্তব্য ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করেছে। রাজ্য বিজেপির একাংশ তাই অভিযোগ করতে শুরু করেছিল যে, দিলীপের মন্তব্য দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। সম্প্রতি সে সব বিতর্ক আরও বাড়ে। সভাস্থল দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স যেতে দিচ্ছেন না দিলীপ, অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে বলছেন— এই ছবি সম্প্রতি তীব্র বিতর্ক তৈরি করে। কিন্তু দিলীপ ঘোষ তা নিয়ে অনুতাপ ব্যক্ত করেননি। পশ্চিমবঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সে সব সময় রোগী থাকে না, সোনা পাচারও হয় এবং প্রয়োজনে তিনি আবার অ্যাম্বুল্যান্স আটকাবেন— এ রকমও বলেন দিলীপ।

সে বিতর্ক থামার আগেই নতুন বিতর্ক শুরু হয় দিলীপের ‘গুলি করে মারব’ মন্তব্য নিয়ে। সিএএ-র বিরোধিতায় যাঁরা পথে নেমে উপদ্রব করছিলেন, অসমে এবং উত্তরপ্রদেশে বিজেপির সরকার তাঁদের গুলি করে মেরেছে বলে দিলীপ মন্তব্য করেন। বিজেপি ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গেও একই কাজ করা হবে— বলেন দিলীপ। ‘‘আমরা লাঠিও মারব, গুলিও করব, জেলেও ঢোকাব’’— রানাঘাটের জনসভা থেকে এ রকমই বলেন তিনি।

দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে রাজ্য বিজেপির একটি অংশ অনেক দিন ধরেই সক্রিয় ছিল। দিলীপের উপর্যুপরি বিতর্কিত মন্তব্যের পরে সেই অংশ আর উষ্মা গোপন রাখেনি। দলের মধ্যে অনেকেই তোলপাড় শুরু করেছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় দলের বাইরেও মুখ খুলে দেন। টুইট করে দিলীপ ঘোষের মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন তিনি। দিলীপ ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কথা বলছেন বলেও বাবুল সেখানে লেখেন। সেই টুইটকে আবার রিটুইট করেন রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত।

অর্থাৎ বিজেপিতে দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে শোরগোল আর ছোটখাট পর্যায়ে ছিল না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা মোদী-শাহের সুনজরে থাকা কোনও সাংসদ যখন দিলীপের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন, তখন দলের ভিতরের পরিস্থিতিটা কতটা উত্তপ্ত হয়ে থাকতে পারে, তা বোঝা শক্ত নয়।

দিলীপের জন্য ‘হার্ডল’ তৈরি রেখেছিল সাম্প্রতিক উপনির্বাচনের ফলাফলও। রাজ্যের ৩টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে জেতা এবং বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে থাকা আসনেও বিজেপি প্রার্থীদের হার প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিল দিলীপের নেতৃত্বকে। করিমপুরের হার নিয়ে খুব হইচই হয়নি। কিন্তু কালিয়াগঞ্জ এবং খড়্গপুর সদরে কী করে হারল বিজেপি? এই প্রশ্ন নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল দলের অন্দরে। মেদিনীপুর আসন থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হওয়ার পরে খড়্গপুর সদর বিধানসভা আসন ছেড়ে দেন দিলীপ। দলের বড় অংশের আপত্তি অগ্রাহ্য করে সে আসনে নিজের অনুগামী প্রেমচাঁদ ঝাকে প্রার্থী করেন তিনি। প্রেমচাঁদকে জেতানোর দায়িত্ব তাঁর— এমন চ্যালেঞ্জও দিলীপ নিয়েছিলেন। কিন্তু চ্যালেঞ্জে উতরোতে পারেননি। অতএব দলের অন্দরে তাঁর বিরোধীরা তাঁকে সরানোর দাবি তীব্র করতে শুরু করেন।

এত কিছুর পরেও দিলীপে আস্থা কেন? বিজেপি সূত্রের খবর, কারণ মূলত তিনটি।

প্রথমত, গত চার বছরে দিলীপ ঘোষ নিজের ‘ফায়ারব্র্যান্ড’ ভাবমূর্তি তৈরি করতে সফল হয়েছেন, যাতে দলের লাভ হয়েছে। দিলীপের নানা মন্তব্য নানা সময়ে বিতর্ক তৈরি করেছে, সে কথা ঠিক। কিন্তু এত দিনে সোজাসাপটা কথা বলার মতো একজন নেতা এসেছেন অথবা তৃণমূলকে পাল্টা চোখ রাঙানোর মতো একটা নেতা পাওয়া গিয়েছে— এ রাজ্যের ভোটারদের অনেকেই এ রকম মনে করেন দিলীপের বিষয়ে।তাই দিলীপকে এখনই সরিয়ে দিতে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতারা চাইছেন না।

দ্বিতীয়ত, সভাপতি পদে দিলীপ ঘোষ এবং সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) পদে সুব্রত চট্টোপাধ্যায়— এই জুটির নেতৃত্বেই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফলাফল করেছে বিজেপি। দিলীপ-সুব্রতর মধ্যে সম্পর্ক এখন কেমন, তা নিয়েও নানা জল্পনা রয়েছে। কিন্তু দিনের শেষে তাঁরা সব দিক সামলেই এগোচ্ছেন বলে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছে। এই মুহূর্তে তাঁদের কোনও এক জনকে বা দু’জনকেই সরিয়ে দিয়ে নতুন কাউকে দায়িত্ব দিলে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে নতুন নেতৃত্বের সময় লেগে যাবে বলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মত। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাংলায় দলকে আর সেই পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করাতে চাইছে না দিল্লি। খবর বিজেপি সূত্রেরই।

তৃতীয়ত, এ রাজ্যের বিজেপিতে খুব হেভিওয়েট বা সব মহলে জনপ্রিয় মুখের যে ছড়াছড়ি রয়েছে, এমনও নয়। সুতরাং দিলীপ ঘোষকে সরিয়ে দেওয়া হলে কাকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। অতএব দিলীপেই আপাতত আস্থা রেখেছে দল। আগামী তিন বছরের জন্য দিলীপ ঘোষই নেতৃত্ব দেবেন রাজ্য বিজেপি-কে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dilip GHosh BJP BJP State President
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE