মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অনেক চাষি। সরকারকে সরাসরি ধান বেচতে ক্রয় কেন্দ্রের পথ মাড়াচ্ছেন না তাঁরা। খাদ্য দফতর বলছে, রাজ্যের মানুষকে দু’টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল দিতে এ বছর ৫২ লক্ষ মেট্রিক টন ধান দরকার। কিন্তু কেনাকাটা শুরুর প্রথম মাসে সরকারের ঘরে জমা পড়েছে মাত্র আড়াই লক্ষ মেট্রিক টন ধান। পরিস্থিতি বিবেচনা করে অবশেষে ধান বেচাকেনার হাল ধরতে জেলায় জেলায় সচিবদের পাঠাচ্ছে নবান্ন।
কুইন্টাল-পিছু ১৪৭০ টাকা দর দিয়েছে সরকার। তবু অনেক চাষি লোকসান দিয়েও ১৩০০ টাকাতেই ধান বেচছেন মহাজনদের কাছে। কেন? সরকারকে ধান বেচতে কেন অনীহা চাষিদের? মূলত এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজবেন আমলারা।
কোন সচিব কোন জেলায় যাবেন, মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় গত সোমবার নির্দেশ জারি করে তা জানিয়ে দিয়েছেন। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা জানান, সমবায় ও খাদ্য দফতরের মন্ত্রী ও অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যসচিব। সেখানেই অফিসারেরা জানান, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ ধান কেনার সেরা সময়। কিন্তু পরিস্থিতি যা, তাতে সরকার এখনই হস্তক্ষেপ না-করলে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কার্যত অসম্ভব। তার পরেই প্রায় নজিরবিহীন ভাবে সচিবদের জেলায় পাঠিয়ে ধান কেনায় গতি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় নবান্ন।
লালগড় আন্দোলনের গোড়ায় বাসিন্দাদের মন বুঝতে জঙ্গলমহলে আইএএস-দের পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই আমলাদের রিপোর্ট বাস্তবায়নের আগেই অবশ্য মাওবাদীরা গোটা জঙ্গলমহল কব্জা করে ফেলে। ফলে রিপোর্টটি ফাইলবন্দি থেকে যায়। এ বার পরিস্থিতি সামাল দিতে ধানি জেলাগুলিতে পাঠানো হচ্ছে সচিবদের। নবান্নের এক কর্তার বক্তব্য, খাদ্যসাথী প্রকল্পে দু’টাকা কেজি দরে চাল দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। কার্যত এই প্রকল্পের দাপটেই গত বিধানসভা ভোটে ধরাশায়ী হয়েছে বিরোধী শিবির। একমাত্র খাদ্যসাথীকে সামনে রেখেই সরকার রেড রোডে অনুষ্ঠান করে। ‘‘সেই প্রকল্প বছরের গোড়াতেই গোত্তা খাওয়ায় ক্রমশই চিন্তা বাড়ছে,’’ বলেন ওই নবান্ন-কর্তা।
সচিবেরা জেলায় কী করবেন?
দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সচিব জানাচ্ছেন, সরকারকে ধান বেচতে চাষিদের অনীহা কেন, অন্য কোনও প্রলোভন আছে কি না— মূলত এগুলোই খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে সচিবদের। জেলাশাসকদেরও ধান কেনার কাজে নামাচ্ছে নবান্ন। এসডিও, বিডিও-রা যাতে আরও বেশি প্রাথমিক কৃষি সমবায় ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেন, সে-দিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে জেলাশাসকদের। এর পরেও সরকার ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারবে কি না, সংশয়ে খাদ্যকর্তাদের একাংশ।
পরিস্থিতি এমন হল কেন?
কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খাদ্যকর্তাদের একাংশ বলছেন, এ বছরই প্রথম অনলাইনে চাষিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরকারের দেওয়া সহায়ক মূল্য জমা পড়ছে। কিন্তু অজস্র প্রান্তিক চাষির অ্যাকাউন্ট না-থাকায় তাঁরা সরকারকে ধান বেচতে চাইছেন না। যাঁদের অ্যাকাউন্ট আছে, তাঁদেরও অনেকে হাতে নগদ টাকা পাওয়ার আশায় অন্যত্র ধান বেচছেন। এর পিছনে এক শ্রেণির মহাজন ও চালকল-মালিকের কারসাজি দেখছেন ওই খাদ্যকর্তারা। তাঁরা জেনেছেন, সরকারি দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও প্রতি কুইন্টালে প্রায় ১৭০ টাকা লোকসান দিয়েও মহাজনদের কাছে ধান বেচতে কার্যত বাধ্য হচ্ছেন বহু চাষি। কারণ, ওই মহাজনেরা চাষিদের হুমকি দিচ্ছেন, তাঁদের কাছে ধান বিক্রি না-করলে চাষের মরসুমের শুরুতে আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। সেই হুমকি অনেকটা ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। এর উপরে হাতে হাতে নগদলক্ষ্মী ঘরে তোলার হাতছানি তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে সহায়ক মূল্য বেশি হওয়া সত্ত্বেও সরকারকে ধান বিক্রি থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন চাষিরা।
খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য এই পরিস্থিতির জন্য নোট বাতিলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকেই দায়ী করছেন। তাঁর বক্তব্য, পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ায় রাজ্য সরকার সহায়ক মূল্য কবুল করেও ধান কিনতে পারছে না। অন্য দিকে ব্যাঙ্কের নতুন নিয়মে কৃষকেরাও ধান বেচতে রাজি হচ্ছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy