স্কুলবাড়ির সামনে রেজাউল করিম (ডান দিকে) ও তাঁর দাদা ফজলুল কবীর।
সার সার মাটির দেওয়াল, টালি আর খ়ড়ে ছাওয়া ছাদ। রাস্তা জুড়ে গোরু, ছাগল, হাঁস-মুরগির অবাধ খুনসুটি। কখনও-সখনও পুকুর, বিল, বিঘের পর বিঘে বিস্তীর্ণ ধানি জমির পাশ দিয়ে দু’একটা গাড়ি ঢুকে পড়লে ভি়ড় করে আসে ছেলেপুলের দল। একেবারে আদর্শ ‘পল্লীসমাজ’। কিন্তু এই ২০১৬-তেও কোনও ডাক্তার নেই। শুধু ওই গ্রামে কেন, তার আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামেও। সব চেয়ে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্র ১০ কিলোমিটার দূরে। ট্রেন ধরতে স্টেশন যেতে গেলে বেশির ভাগ সময়েই হাঁটতে হয় ১৫ কিলোমিটার। বড় অসুখ-বিসুখে হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই মৃত্যুর ঘটনা অহরহ। একটা প্রসূতি কেন্দ্র গড়ার কথা হয়েছিল বছর কয়েক আগে। সেটাও হয়নি। গ্রামে স্কুল আছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে লেখাপড়ার হাল খুব খারাপ।
এমন একটা পরিবেশে আজন্ম বেড়ে ওঠা বৃদ্ধা খায়রুন্নেসা চেয়েছিলেন, বদল আসুক। মানুষগুলো প্রাণে বাঁচুক। ডাক্তার তৈরি হোক। কিন্তু ভাল স্কুলই যদি না থাকে, তা হলে শিশুদের শিক্ষার ভিতটা শক্তপোক্ত হবে কী করে? ভবিষ্যতের কৃতী ডাক্তার তৈরি করার জন্য শিক্ষার ভিতটা যে মজবুত হওয়া দরকার, তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তিনি।
জীবদ্দশায় খায়রুন্নেসা যা পারেননি, মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলেরা সেই স্বপ্নকে সফল করতে এগিয়ে এসেছেন। নিজেদের যাবতীয় সঞ্চয় ব্যয় করে বীরভূমের মুরারই থানার প্রত্যন্ত গ্রাম সদাশিবপুরে একটি স্কুল গড়ে তুলেছেন ছেলেরা, যাঁদের মধ্যে একজন এই মুহূর্তে রাজ্যের একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রে়ডিওলজি বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক। তাঁর দাবি, সাধারণ প্রথাগত শিক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকবে না ওই স্কুল, পড়ুয়াদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক শিক্ষায় সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন স্কুলের শিক্ষকেরা। নতুন বছরের প্রথম দিনে স্কুলটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার কথা। জানুয়ারির শেষ থেকেই শুরু হবে ক্লাস।
রূপকথার মতো এই গল্পের শুরুটা অবশ্য বহু বছর আগে। বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে খায়রুন্নেসার মা গুল আঙ্গেজ নিজেই ছিলেন খানিকটা ‘সৃষ্টিছাড়া’। ব্রিটিশ আমলে বহু বছর বাড়িতে একটি ‘স্কুল’ চালিয়েছেন তিনি। সিলেবাস মেনে প্রথাগত পড়াশোনা না হলেও আরবি, ফারসি, অঙ্ক-সহ আরও বেশ কিছু বিষয় শেখানো হতো সেই স্কুলে। বেশির ভাগটাই শেখাতেন তিনি নিজে। মেয়েকে বড় করে তুলেছিলেন সে ভাবেই। নিজের বিয়ে, পাঁচ-পাঁচটি সন্তান হওয়ার পরেও লেখাপড়ার খিদেটা মেটেনি খায়রুন্নেসার। সংসারের কাজ সামলে চালিয়ে যেতেন পড়াশোনা। আর চাইতেন শুধু নিজের সন্তান নয়, চারপাশের লোকজনও যেন শিক্ষিত হতে পারে। একের পর এক নিজের গয়না বিক্রি করে নিজের ছেলেদের, আত্মীয়ের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন তিনি। নিজের এক ছেলে কৃতী ডাক্তার হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে তাঁর নিজের গ্রাম কী পেয়েছে? এই প্রশ্ন অহরহ বিঁধত খায়রুন্নেসাকে। আর সেই অস্থিরতা থেকেই গ্রামে সব অর্থেই একটি আধুনিক স্কুল তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। তিন বছর আগে, ৮০ বছর বয়সে নিজের ওই স্বপ্নকে অপূর্ণ রেখেই মারা যান তিনি। আর তার পরই স্বপ্নটা সংক্রমিত হয় তাঁর ছেলে, চিকিৎসক রেজাউল করিমের মধ্যে। এগিয়ে আসেন তাঁর আরও দুই ছেলে ফজলুল কবীর এবং হুমায়ুন কবীর। স্কুল গড়তে নিজেদের জমি দিয়ে দেন তিন জনেই। যাবতীয় আর্থিক সঞ্চয় ঢালতে শুরু করেন রেজাউল। আপাতত কো-এডুকেশন স্কুলটির বাড়ি মোটামুটি তৈরি। এখন প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস শুরু হবে। তার পর ধাপে ধাপে তৈরি হবে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। স্কুলের শিক্ষকরা আসবেন দূরের জেলা বা শহর থেকে। তাঁদের থাকার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে গ্রামে।
খায়রুন্নেসা
এর পর চলবে কী করে? জানা গেল, স্কুলে পড়ার জন্য খুবই সামান্য বেতন নেওয়া হবে পড়ুয়াদের থেকে। এ ছাড়া আপাতত টাকার জোগান দেবেন রেজাউল নিজেই। এই জন্যই সরকারি হাসপাতালের ডিউটি শেষ হওয়ার পরে আপাতত প্র্যাকটিশের সময়টাও বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
স্কুলবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চলছিল স্মৃতিচারণ। ছোটবেলায় এক দিন পড়া ফেলে নমাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। বাধা দিয়েছিলেন তাঁর মা। বলেছিলেন, ‘‘এই বয়সে তোমার যে দিকে মন দেওয়া দরকার, তুমি শুধু সেটাই করো।’’ রেজাউল বলেন, ‘‘একটা কথা মা খুব বলতেন— ‘নিজে শিক্ষিত হওয়া আর অন্যকে শিক্ষিত করার চেয়ে বড় ধর্ম আর কিছু নেই।’ আমি সেটাই মানার চেষ্টা করছি।’’ স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল মতিন, যাঁকে এলাকার সবাই ‘পীরসাহেব’ বলে সম্বোধন করেন, তিনি বললেন, ‘‘মুক্তচিন্তা ছাড়া ভাল মানুষ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। এই অস্থির সময়ে একটা মুক্ত চিন্তার স্কুল খুব দরকার ছিল। একে ঘিরে এখন আমাদের অনেক আশা।’’
স্কুলের পাশেই সর্ষে খেত। হলুদ আলো ছড়াচ্ছে চার পাশে। সে দিকে তাকিয়ে রেজাউল জানাচ্ছিলেন তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। আরও জমি দরকার। কারণ একটা ভাল লাইব্রেরি তৈরি করতে হবে। ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠও দরকার। ‘‘কর্মসূত্রে গ্রামের বাইরে থাকতে হলেও গ্রামের মানুষকে আমি ভুলিনি। ভুলিনি আমার মায়ের লড়াইয়ের কথাও। তাই সামান্য কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’’
মাতৃঋণ শোধের চেষ্টা? ‘‘ধুর, তা কখনও হয় নাকি? বরং মাতৃঋণ স্বীকার করা বলতে পারেন।’’ বিষণ্ণ শোনায় প্রৌঢ় চিকিৎসকের গলা।
— নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy