Advertisement
E-Paper

পেনডেন্ট থেকে সাবান কেস, বিবর্তনে ডোকরা

চেনা ছক ভেঙে বেরিয়ে এসে গায়ে মেখেছে যুগের হাওয়া। আর তাতেই বদলে গিয়েছে বাজারের চিত্রটাও! কয়েক বছর আগেও ‘ডোকরা শিল্প’ মানেই ছিল দেবদেবীর মূর্তি, পুজোর সরঞ্জাম ও হাতি-ঘোড়া। খুব বেশি হলে ঘর সাজানোর কিছু মূর্তি গড়তেন শিল্পীরা।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৫ ০২:১১
হুঁকো থেকে হ্যাঙার— কী না তৈরি করছেন বাঁকুড়ার ডোকরা শিল্পীরা? ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

হুঁকো থেকে হ্যাঙার— কী না তৈরি করছেন বাঁকুড়ার ডোকরা শিল্পীরা? ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

চেনা ছক ভেঙে বেরিয়ে এসে গায়ে মেখেছে যুগের হাওয়া। আর তাতেই বদলে গিয়েছে বাজারের চিত্রটাও!

কয়েক বছর আগেও ‘ডোকরা শিল্প’ মানেই ছিল দেবদেবীর মূর্তি, পুজোর সরঞ্জাম ও হাতি-ঘোড়া। খুব বেশি হলে ঘর সাজানোর কিছু মূর্তি গড়তেন শিল্পীরা। মূলত এই ছিল তাঁদের কাজের চেনা গণ্ডি। তবে গত বছর তিনেকে শিল্পসম্ভারের ঝুলিতে নতুন ভাবে সংযোজিত হয়েছে অনেক কিছুই। যা আকৃষ্ট করছে বিভিন্ন শ্রেণির ক্রেতাদের। রোজগার বেড়ে মুখে হাসি ফুটেছে শিল্পীদেরও।

জামাকাপড় রাখার হ্যাঙার থেকে পর্দা টাঙানোর ক্লিপ, গ্রিল থেকে শুরু করে মেয়েদের পার্সের বোতাম সবেতেই ঢুকে পড়েছে ডোকরা। ডোকরা শিল্পীদের গ্রাম বিকনার শিল্পডাঙায় গাড়ি নিয়ে এসে কানের দুল, গলার হার, হাতের বালা, চাবির রিং বাছাই করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। সাধ করে বাড়ির জন্য ডোকরার গ্রিল, দরজার কড়া তৈরিরও বরাত দিয়ে যাচ্ছেন রুচিশীল ক্রেতারা। বাড়ির ড্রেসিংটেবিলের চারপাশ ডোকরার শিল্প কলা দিয়ে মুড়িয়ে দিতে শিল্পীদের নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। বাথরুমের শোভা বাড়াতে ডোকরার সাবান কেস গড়ার বরাতও কম মিলছে না। আবার নজর কাড়তে রকমারি নকশার ডোকরার পেপার ওয়েটও কিছু কম যাচ্ছে না।

গ্রামের আটচালায় ডোকরার মূর্তি গড়ায় ব্যস্ত শিল্পী চন্দন কর্মকারের কথায়, “শীঘ্রই কলকাতায় মিলন মেলা। ক্রেতাদের মনজুগিয়ে গৃহসজ্জার জিনিসপত্র ও অলঙ্কার নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে ভালই সাড়া ফেলবে বলেই আমরা আশাবাদী।” তিনি জানাচ্ছেন, বছর তিনেক ধরেই ডোকরা শিল্পে চেনা গতের বাইরে এসে নতুন কিছু গড়ার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। মাটি, ধুনো বাদ রেখে শুধু মোম ও পিতল দিয়ে ছোট ছোট অলঙ্কার বানানো শুরু করেছিলেন শিল্পীরা। ধীরে ধীরে বাজারে এর চাহিদা বাড়তে থাকে। তারপর থেকেই ঘর সাজানোর জিনিসপত্র ও নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের মধ্যেও ডোকরাকে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রয়াস শুরু করেন শিল্পীরা।

প্রবীণ শিল্পী ধীরেন কর্মকার জানান, মাস খানেক আগেই কলকাতার এক ব্যক্তি বাড়িতে গিয়ে তিনি ডোকরার রেলিং বসিয়ে এসেছেন। গ্রামে এসে বরাত দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শিল্পীরা বরাত অনুযায়ী তৈরি করে লাগিয়ে দিয়ে এসেছেন। তিনি জানাচ্ছেন ড্রেসিংটেবিলের চারপাশে ডোকরার কাজ করাতেও অনেকে শিল্পীদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া কপাটে ডোকরার কড়াও বসাচ্ছেন অনেকে। কয়েক মাস আগেই ডোকরা শিল্পীদের এই গ্রামে বসেছিল ডোকরা মেলা। বাইরে থেকে বহু মানুষ এসে নানা জিনিসপত্র কিনে নিয়ে গিয়েছেন। চন্দনবাবুর কথায়, “এখন মূর্তি, হাতি ঘোড়ার চেয়েও ডোকরার হ্যাঙার, হাতের বালা, কানের দুল, পেপারওয়েটের মতো জিনিসপত্রের বিক্রি অনেক বেশি।” তিনি জানান, প্রায় প্রতিদিনই দুর্গাপুর, আসানসোল, কলকাতা থেকে সপরিবারে গাড়ি নিয়ে অনেকেই তাঁদের গ্রামে আসছেন। পছন্দ করে অলঙ্কার থেকে ঘর সাজানোর নানা জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

এই শিল্পডাঙায় বর্তমানে প্রায় ৬৫টি পরিবারের বাস। সকলেই ডোকরা শিল্পী। এই গ্রামেরই যুদ্ধ কর্মকার ডোকরার মনসাঝাড় তৈরি করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর হাতের কাজেই ডোকরার পরিচিতি অন্যমাত্র পায়। যুদ্ধবাবু পুরস্কার পাওয়ার পরেই ডোকরার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। তিনি এখন প্রয়াত। ধীরে ধীরে বাজারে চাহিদাও বাড়তে থাকে ডোকরার।

তবে নব্বইয়ের দশকে লোকসানের মুখে পড়ে এই শিল্প। পরিস্থিতি এমনই হয় যে জীবনধারনের জন্য বহু শিল্পীই শিল্পকর্ম ছেড়ে রিকশা চালানো, দিনমজুরি শুরু করেন। যদিও চিত্রটা বদলে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। চন্দনবাবুদের মতে এক সময় কেবল ঠাকুরঘরের শোভা বাড়াত ডোকরা শিল্প। এখন সাধারণ মানুষের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যেও ডোকরা ঢুকে গিয়েছে। নতুন করে বাজার ফিরে পাওয়ার এটাই অন্যতম কারণ বলে দাবি করছেন শিল্পীরা। সরকারের তরফেও শিল্পীদের নানা সহযোগিতা করা হচ্ছে।

জেলা পরিষদের ক্ষুদ্র, কুটির ও বিদ্যুৎ দফতরের কর্মাধ্যক্ষ সুখেন বিদ বলেন, “ডোকরা শিল্পীদের কাছে ব্যবসার একটা নতুন দিক খুলে গিয়েছে। আমরা সরকারি মেলাগুলির মাধ্যমেও বাইরের ক্রেতাদের কাছে ডোকরাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।” আগামী দিনে ডোকরার চাহিদা কী ভাবে বাড়ানো যায় সে দিকেও সরকারের নজর রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

কলকাতার মিলন মেলায় শিল্পসম্ভার নিয়ে যেতে শেষ মুর্হুতের প্রস্তুতি সারতে ব্যস্ত এই গ্রামের দম্পতি পুতুল কর্মকার ও বচন কর্মকার। মূর্তি পালিস করতে করতে পুতুলদেবী বলেন, “এ বার ধনতেরাসেও অনেকে গ্রামে এসে ডোকরার অলঙ্কার কিনে নিয়ে গিয়েছেন। আজকাল বিয়ে বাড়িতেও উপহার হিসেবে ডোকরার অলঙ্কারের চল বাড়ছে। সারা বছরই একটা বাজার পাচ্ছি আমরা।”

শীতের মরসুমে রাজ্যের নানা এলাকা মেতে উঠবে মেলায়। ডোকরা শিল্পীরা শিল্পসম্ভার নিয়ে যাবেন মেলায়। কলকাতার মিলন মেলা দিয়েই যা শুরু হবে। বচনবাবু বলেন, “গ্রামের ডোকরা মেলায় অনেক লাভ হয়েছে। কলকাতা ও তারপর শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলাতেও ভাল ব্যবসার আশা করছি আমরা।” একই আশায় বুক বেঁধেছেন শিল্পডাঙার বসতিরা।

dokra artisans bikna bankura pendent soap case essential items rajdeep bandopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy