Advertisement
০৫ মে ২০২৪

ফেল করলে স্কুলেই এ বার বাড়তি ক্লাস

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ক্লাস নেওয়ার সময় সপ্তাহে আট ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়াতে হবে বলে সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এ বার অতিরিক্ত সময় ক্লাস নেওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে স্কুলেও। তবে সেটা মূলত পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্যই।

মধুরিমা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৮:৫৪
Share: Save:

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ক্লাস নেওয়ার সময় সপ্তাহে আট ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়াতে হবে বলে সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এ বার অতিরিক্ত সময় ক্লাস নেওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে স্কুলেও। তবে সেটা মূলত পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্যই।

প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারেই বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা পড়ুয়াদের জন্য স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও বাড়তি সময় দিতে হবে পঠনপাঠনে। টিএসআর সুব্রহ্মণ্যমের নেতৃত্বে গড়া কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির খসড়ায় এই ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। সেই খসড়া প্রস্তাব নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে তর্কবিতর্কও।

প্রস্তাবিত নীতিতে বলা হয়েছে, কোনও পড়ুয়া ষাণ্মাষিক পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে অকৃতকার্য হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক বা শিক্ষিকারা স্কুল ছুটির পরে সেই ছাত্র বা ছাত্রীকে ওই বিষয়গুলি বিশেষ ভাবে পড়াবেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে ফের ওই বিষয়ের পরীক্ষা নিতে হবে স্কুলকে। তখনও যদি দেখা যায় সংশ্লিষ্ট পড়ুয়া ফের ফেল করেছে, সে-ক্ষেত্রে আবার একই ভাবে বাড়তি ক্লাস নিয়ে তাকে বা তাদের পড়াতে হবে এবং পরীক্ষা নিতে হবে। সেই বিশেষ পরীক্ষায় কেউ পাশ করতে না-পারলে এবং বার্ষিক পরীক্ষাতেও ফেল করলে তাকে রেখে দেওয়া হবে একই ক্লাসে।

শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকার বছরে মোট এক হাজার ঘণ্টা পড়ানোর কথা। এ রাজ্যে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নিয়ম অনুযায়ী দিনে (শনিবার বাদে) পাঁচ ঘণ্টা ৫০ মিনিট ক্লাস নিতে হবে শিক্ষকদের। সে-ক্ষেত্রে বাড়তি একটি ক্লাস নেওয়া মানে আরও অন্তত ৪০ মিনিট পড়াতে হবে পড়ুয়াকে। সাধারণত পর্ষদের নিয়ন্ত্রণে থাকা স্কুলগুলিতে ক্লাস শুরু হয় ১০টা ৫০ মিনিটে। আট পিরিয়ডের ক্লাস শেষ হয় বিকেল সাড়ে ৪টেয়। তার পরে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া যাবে কী ভাবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে, কোনও পড়ুয়াকে এ ভাবে বারবার সুযোগ দেওয়াই বা হবে কেন?

কোনও কোনও ছাত্র বা ছাত্রীকে যে এ ভাবে বারে বারে সুযোগ দিতে হচ্ছে, এটাকে নিজেদের ব্যর্থতা বলেই মনে করছেন অনেক শিক্ষক। টাকি বয়েজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরেশকুমার নন্দ বলছেন, ‘‘একটা বাচ্চাকে মিড-ডে মিল, কন্যাশ্রী, বিনি পয়সায় ব্যাগ, জামা, জুতো দেওয়ার পরেও যদি তাকে ফেল করানো হয়, সেই ব্যর্থতার দায় এসে পড়ে শিক্ষকদের উপরেই। পড়াতে পারিনি বলেই ফেল করেছে। তাই অতিরিক্ত সুযোগ তাকে দিতেই হবে।’’ একই সঙ্গে পরেশবাবু জানাচ্ছেন, কোনও পড়ুয়া ফেল করলে তাদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়াকে বলা হয় ‘রেমিডিয়াল টিচিং’। এই ব্যবস্থা কাগজে-কলমে দীর্ঘদিন ধরেই চালু আছে। কিন্তু কোথাও তা মেনে চলা হয় না।

২০০৭ সালে এই রাজ্যে রেমিডিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা নতুন করে চালু করেছিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। কিন্তু কিছু দিন চলার পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ উঠতে থাকে, স্কুলে অতিরিক্ত সময় দেওয়ার থেকে ব্যক্তিগত কোচিংকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।

এই অবস্থায় অতিরিক্ত ক্লাসের বন্দোবস্ত ফিরিয়ে আনার উদ্যোগকে সমর্থন করছেন সরকারি স্কুলশিক্ষক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি দীপক দাস। তিনি জানান, কোনও পড়ুয়া একটু পিছিয়ে পড়লে তাকে অন্যদের সঙ্গে সামনের সারিতে এগিয়ে আনার দায়িত্ব শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই। ‘‘স্কুল ছুটির পরে পড়ানোর বিষয়টি তো আজকের নয়। এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু এই ঔচিত্যটাকেই নীতির মাধ্যমে প্রয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। কারণ, প্রায় কোথাও শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজের থেকে সেই উচিত কাজটা করতে এগিয়ে আসেন না,’’ আক্ষেপ দীপকবাবুর।

কোনও কোনও শিক্ষক বা শিক্ষিকা অবশ্য এগিয়ে আসতে রাজি। ইচ্ছে থাকলে স্কুল ছুটির পরে না-হলেও বিভিন্ন পিরিয়ডের মাঝখানে ফাঁকা সময়ে এই ধরনের পড়ুয়াদের পড়া দেখিয়ে দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্বপ্না সিংহ। ‘‘বছর দশেক আগেও আমাদের স্কুলে এই ব্যবস্থা ছিল। তার পরে আর হয়ে ওঠেনি। এ বারেও মনে হয়, এই প্রস্তাব কাগজে-কলমেই থেকে যাবে,’’ আক্ষেপ স্বপ্নাদেবীর।

ইচ্ছে থাকলেও সময় পাওয়া যাবে কী ভাবে, সেই প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাকেই দূরের দূরের স্কুলে পড়াতে যেতে হয়। সে-ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্লাসের ফলে তাঁরা কখন ছুটি পাচ্ছেন, সেটাও বিবেচনা করে দেখার আর্জি জানানো হচ্ছে শিক্ষক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে। তবে দীপকবাবুর বিশ্বাস, নীতি মেনে যখন শিক্ষকদের বাড়তি সময় দিতেই হবে, নিশ্চয়ই তার অন্য দিকগুলোও ভেবে দেখবে সরকার।

স্কুল ও বাড়ির মধ্যেকার দূরত্বের বিষয়টিকে পড়ুয়াদের দিক থেকেও দেখতে চাইছেন অনেক শিক্ষক। এবং সে-ক্ষেত্রে বাড়তি ক্লাসের দরুন পড়ুয়াদের উপরে বাড়তি মানসিক চাপের আশঙ্কাও করছেন তাঁরা। প্রশ্ন তুলছেন, দিনের অনেকটা সময় ক্লাস করার পরে সহপাঠীরা যখন বাড়ি চলে যাচ্ছে, তখন কোনও পড়ুয়াকে তার ফেল করা বিষয়ে বাড়তি পাঠ দিলে সেটা আদৌ ফলপ্রসূ হবে কি?

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় মনে করেন, বিশেষ শ্রেণির পড়ুয়াদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। ‘‘কিন্তু শিক্ষক যদি মনে করেন তিনি অকারণে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করছেন, তা হলে এই বাড়তি ক্লাস কোনও কাজেই আসবে না। শিক্ষকের কাজ হবে, বন্ধুর মতো মিশে অকৃতকার্য পড়ুয়ার মনের ভয় কাটানো, পড়াশোনার বিষয় নিয়ে গল্প করা,’’ বলছেন আনন্দদেববাবু।

এই অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার পরিকল্পনাটিকে ‘আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা’ বলে মনে করছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়। তবে কয়েকটি সমস্যার দিকে নজর দিতে বলছেন তিনি। তার মধ্যে অবশ্যই আসবে শিক্ষকের মানসিকতার কথা। অমলবাবু মনে করেন, ছাত্র গড়ার মানসিকতাই হারিয়ে ফেলেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এই পরিস্থিতিতে ক’জন শিক্ষক পিছিয়ে পড়া পড়ুয়ার কথা ভাবেন বা ভাববেন, সেই বিষয়ে তাঁর সন্দেহ আছে। অন্যান্য সমস্যার মধ্যে আছে পরিকাঠামোর অভাব। তার মধ্যে আবার শিক্ষকের অভাব সব থেকে বড় সমস্যা। ‘‘স্কুলে শিক্ষক-ঘাটতির সমস্যার তো কোনও সমাধানই হচ্ছে না। যাঁরা নিয়মিত ক্লাস নিতেই হিমশিম খাচ্ছেন, তাঁরা অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার সময় পাবেন কী ভাবে,’’ প্রশ্ন অমলবাবুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

school class
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE