ভিন রাজ্য থেকে আসছেন ব্যবসায়ী কিংবা তাঁর প্রতিনিধি। আর মালদহ থেকে ফেরত যাওয়ার সময়ে তাঁদের সঙ্গে থাকছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
গ্রামের নাম দুইশত বিঘি। বৈষ্ণবনগর এলাকার ওই গ্রামেই দাঁড়িয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। এক বস্ত্র ব্যবসায়ীর প্রতিনিধি সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশ থেকে বিস্তর দূরত্ব ঠেঙিয়ে মালদহ জেলার ওই প্রত্যন্ত গ্রামে এসে হাজির হয়েছিলেন।
প্রায় একই সময়ে দুইশত বিঘি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে চাইপাড়া-মোহনপুর-সুখপাড়ার মতো তল্লাটে ওড়িশা থেকে উজিয়ে এসেছিলেন কেটারিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি।
দু’জনের কেউই বস্ত্র বা কেটারিং ব্যবসা সংক্রান্ত কোনও কাজে মালদহ আসেননি। আবার তাঁদের আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িও মালদহে নেই। ওই দু’জনই মোটা অঙ্কের নগদ নিয়ে মালদহে এসেছিলেন। ফিরে গিয়েছেন আরও বেশি নগদ নিয়ে।
ব্যাপারটা তা হলে কী? জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) গোয়েন্দারা জেনেছেন, ওই দু’জন আসল ভারতীয় টাকার নোট এনে মালদহ থেকে কিনে নিয়ে গিয়েছেন জাল টাকা। সবই পাঁচশো, হাজারের নোটে।
এনআইএ-র দাবি, প্রোমোটারি, কেটারিং, বস্ত্র ব্যবসার মতো যে সব কারবারে নগদ টাকার লেনদেন অনেক ক্ষেত্রেই বেশি পরিমাণে হয়, সেই সব ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই ইদানীং ভিন রাজ্য থেকে মালদহে এসে নগদ আসল টাকা খরচ করে জাল নোট কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
বহুকাল ধরেই সিআইডি দাবি করে আসছে, মালদহের কালিয়াচক ও বৈষ্ণবনগর এলাকার সীমান্তবর্তী বহু গ্রামের বাসিন্দারা জাল নোটের কারবারকে নিজেদের একমাত্র পেশা করে ফেলেছেন।
আর এই বছর মালদহের কয়েকটি জালনোট সংক্রান্ত মামলার তদন্তের ভার নেওয়ার পর এনআইএ-র দাবি, এখন আর জালনোট ছড়াতে মালদহের কারবারিদের কাঠখড় তেমন পোড়াতে হচ্ছে না। অন্য রাজ্যের ব্যবসায়ীরা কিংবা তাঁদের লোক মালদহে এসে কখনও পাঁচ-দশ, কখনও বিশ লক্ষ, এমনকী, কোনও সময়ে এক লপ্তে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার জালনোটও কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের মতে, বহু কাল ধরেই জাল ভারতীয় টাকার পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ঢুকছে মালদহের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে। কিন্তু এনআইএ-র সাম্প্রতিক তদন্তে মালদহের ‘মর্যাদা’ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে।
এনআইএ-র এক অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতের কয়েক জন প্রোমোটারের কথা জেনেছি। ওঁদের লোক মালদহে এসে কয়েক লক্ষ টাকার জালনোট তিন মাস আগে কিনে নিয়ে গিয়েছে। আমরা ওঁদের উপর নজর রেখেছি।’’
গত ২৩ অগস্ট সল্টলেকের এনআইএ অফিস থেকে পালাতে গিয়ে উঁচু থেকে পড়ে জখম হয় রাজেন চোপড়া নামে প়ঞ্জাবের এক ব্যক্তি। হোটেল ও কেটারিং ব্যবসায় জালনোট ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, জালনোট নিতে এসেই মালদহে এসে মে মাসে ধরা পড়েছিল রাজেন।
এনআইএ-র বক্তব্য, ভিন রাজ্যের ব্যবসায়ীরা সরাসরি মালদহের জাল নোটের খদ্দের— এই নতুন ঝোঁক শুরু হয়েছে দু’বছর যাবৎ।
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এক পড়শি দেশের ‘সিকিওরিটি প্রেসে’ (দেশের টাকা ছাপা হয় যেখানে) ছাপা ভারতীয় জাল নোট বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে চোরাপথে মালদহে ঢোকার পর একটা সময়ে সেখানকার চাঁইরাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিত ‘ক্যারিয়ারদের’ মাধ্যমে। মালদহ থেকে ভিন রাজ্যে রাজমিস্ত্রি, দিনমজুরের কাজ নিয়ে যাওয়া যুবকদের একাংশ ‘ক্যারিয়ার’ হিসেবে কাজ করত। অন্ধ্রপ্রদেশ, গোয়া পুলিশ এসে মালদহ থেকে জাল নোটের কারবারে জড়িত লোকজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছে। ‘‘কিন্তু এখন আর ক্যারিয়ায়ের দরকার খুব বেশি হচ্ছে না। সাধারণ ব্যবসায়ীরাও জাল নোট কিনতে মালদহে লোক পাঠাচ্ছেন’’, বলছেন এনআইএ-র এক কর্তা। তাঁর দাবি, প্রায় গোটা ভারতেই মালদহের জালনোটের ব্যাপক চাহিদা।
কিন্তু কী ভাবে মালদহের এত ‘সুনাম’ ভারতব্যাপী ছড়াল?
তদন্তকারীদের মতে, প্রথমত, মালদহের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ঢোকা জালনোটের মান অনেক ভালো। আসল নোট থেকে সেগুলিকে আলাদা করা বিশেষজ্ঞদের পক্ষেও কঠিন। দ্বিতীয়ত, জাল নোট সংক্রান্ত মামলায় ধৃত মালদহের লোকজনকে বিভিন্ন রাজ্যে হাজতবাস করতে হয়েছে এবং সেই সূত্রে তাদের পরিচয় হয়েছে সেই সব জায়গার দুষ্কৃতীদের সঙ্গে। গড়ে উঠেছে আরও বড় নেটওয়ার্ক।
গোয়েন্দাদের দাবি, ১০০ টাকার জালনোটের দাম আসল নোটে ৩০ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। চাহিদা ও জোগান অনুযায়ী তা কিছুটা বদলায়। ভাল জোগান আছে, এই অবস্থায় বাইরে থেকে মালদহে এসে কেনার ক্ষেত্রে ওই দাম থাকে ৪০ টাকার আশপাশে। তবে মালদহের কোনও চাঁই ‘ক্যারিয়ার’ দিয়ে বাইরে জালনোট বেচতে পাঠালে তার দাম পঞ্চাশ টাকায় উঠে যায়। এনআইএ-র এক অফিসারের কথায়, ‘‘ক্যারিয়ার পাঠানোর ঝক্কি, ধরা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকির কথা মাথায় রাখতে হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy