Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

ভিটে থাকতেও ছাদ হারিয়ে যেন যাযাবর

তাঁর কেউ ভর্তি নেই। তিনি ওখানকার কর্মীও নন। তবু অদৃষ্টের ফেরে এসএসকেএম চত্বরই আপাতত তাঁর সপরিবার ঠাঁই। শ্যামনগরের শ্যামল দেবনাথ আপন ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে সংসার পেতেছেন হাসপাতালের বিশ্রামাগারে।

স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে শ্যামল দেবনাথ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে শ্যামল দেবনাথ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৫
Share: Save:

তাঁর কেউ ভর্তি নেই। তিনি ওখানকার কর্মীও নন। তবু অদৃষ্টের ফেরে এসএসকেএম চত্বরই আপাতত তাঁর সপরিবার ঠাঁই। শ্যামনগরের শ্যামল দেবনাথ আপন ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে সংসার পেতেছেন হাসপাতালের বিশ্রামাগারে।

দিন-রাতের যে কোনও সময় এসএসকেএমে গেলে তাঁর দেখা মিলবে। শীর্ণকায়, রুক্ষ চেহারা। গালে বহু দিনের না-কাটা দাড়ি। ইমার্জেন্সির সামনে দাঁড়িয়ে কারও জন্য ভর্তির ফর্ম ফিলআপ করে দিচ্ছেন। কারও জন্য স্ট্রেচার এনে দিচ্ছেন। এ ভাবে দিন গেলে কয়েকটা টাকা হাতে আসছে। তা দিয়ে স্ত্রী ও মূক-বধির ছেলের মুখে সামান্য খাবার তুলে দেওয়া। কখনও-সখনও লোকের থেকে চেয়ে-চিন্তে খাওয়া।

অথচ আগে বেশ ভাল দিন কেটেছে। উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরেই স্থানীয় রোলিং মিলে কাজ করতেন। এলাকায় হাঁক-ডাকও ছিল। এক দিন কারখানা ঝাঁপ ফেলল। ‘‘কী করব ভেবে যখন দিশেহারা, তখন আমাদের বাড়ি থেকে আমাদেরই জবরদস্তি বার করে দিল জ্ঞাতি ভাইয়েরা। কোথাও সুরাহা পেলাম না!’’— হতাশায় বুজে আসে চৌষট্টির প্রৌঢ়ের গলা।

সে বছর আড়াই আগের ঘটনা। উৎখাত হয়ে প্রথমে কৃষ্ণনগরে শ্বশুরবাড়ির কাছে ঘর ভাড়া নিয়ে ছিলেন। ভাড়ার টাকা মেটাতে না-পেরে বছরখানেক আগে ব্যারাকপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ধারে একচিলতে জায়গায় সংসার পাতেন। ওখান থেকে সোজা এসএসকেএমের ওয়েটিং রুম। গত সপ্তাহ দুয়েক যাবৎ যা তাঁর অস্থায়ী ঠিকানা।

নিজের ভিটে কেন ছাড়তে হল?

শ্যামলবাবু আঙুল তুলছেন পারিবারিক ‘ষড়যন্ত্রের’ দিকে। জানাচ্ছেন, শ্যামনগরে একই জমিতে কাকা অনিল দেবনাথের বাড়ি। কারখানা বন্ধের পরে এক দিন কাকার ছেলেরা তাঁকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। স্থানীয় জগদ্দল থানায় লিখিত নালিশ করেছেন। কড়া নেড়েছেন নেতাদের দরজায়। তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। পুলিশের হেলদোল নেই। আর মকুলবাবু বলছেন, ‘‘পরিবারটি সাহায্য চাইতে এসেছিল। রোজগারের কিছু উপায় ও থাকার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি।’’ এখনও কিছু হয়ে ওঠেনি। ‘জুলুমের’ প্রতিকারও দূর অস্ত্‌। ‘‘যত বার বাড়িতে ফিরতে গিয়েছি, ওঁরা তাড়িয়ে দিয়েছে।’’— বলছেন শ্যামলবাবুর স্ত্রী সোমাদেবী।

অভিযোগের জবাব খুঁজতে শ্যামনগরের আতপুরে গিয়ে দেখা গেল, শ্যামলবাবুর বাড়িতে তালা। সামনেটা আগাছায় ছেয়ে রয়েছে। পাশের বাড়িতে স্ত্রী, তিন ছেলে-বৌমা, নাতি-নাতনি নিয়ে অনিলবাবুর সংসার। প্রশ্ন করতেই অনিলবাবুর ছেলে আশিসের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘‘সব মিথ্যে।’’ ওঁদের কাছে পাল্টা অভিযোগও মজুত। কী রকম?

যেমন, শ্যামলবাবু নিজের মা-বাবাকে দেখতেন না। যে কারণে ওঁর মা-বাবা ছেলের নামে মামলা করেছিলেন। শ্যামলবাবুকে জেলও খাটতে হয়েছে। এবং আশিসবাবুর দাবি— নিজের ছেলের উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়েই জ্যাঠা (শ্যামলবাবুর বাবা) চৌহদ্দির এক কাঠা জমি তাঁর (আশিসবাবু) নামে লিখে দেন। গণ্ডগোল মূলত তা নিয়েই। আশিসবাবুদের বক্তব্য: ওই সময় সোমাদেবী অনিলবাবুর নামে নির্যাতনের নালিশ করেছিলেন থানায়। ‘‘বাবাকে আর ভাইকে পুলিশ অ্যারেস্টও করে। সেই ইস্তক সম্পর্কটা পুরোপুরি বিষিয়ে গিয়েছে।’’— মন্তব্য আশিসবাবুর।

শ্যামলবাবুর মা, বাবা কেউ বেঁচে নেই। জীবিত অবস্থায় তাঁদের তিনি দেখতেন না— খুড়তুতো ভাইয়ের এ হেন অভিযোগ ছেলে মানতে নারাজ। শ্যামলবাবুর দাবি, ‘‘জমির ঝামেলা বা নির্যাতনের মামলার কথা ঠিক। তবে বাবা-মাকে দেখতাম না, এটা মানতে পারছি না। সব চক্রান্ত। আমাকে ভিটেছাড়া করে গোটা জমি কব্জা করতে চায়।’’ বাবা-মায়ের শেষকৃত্যে যাননি কেন জানতে চাইলে প্রৌঢ়ের জবাব, ‘‘আমাকে তো জানানোই হয়নি!’’

পাড়ার এক ক্লাব-সূত্রের খবর: কারখানা বন্ধের পরে শ্যামলবাবুরা আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে বিশেষ সাহায্য পাননি। ‘‘ওঁর ছেলে কথা বলতে পারে না, শুনতেও পায় না। বাবার পাশে যে দাঁড়াবে, সে উপায় নেই। সত্যিই ওঁদের সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে।’’— আক্ষেপ ক্লাবের এক সদস্যের। জগদ্দল থানায় এক অফিসারের অবশ্য নির্বিকার মন্তব্য, ‘‘নির্ভেজাল পারিবারিক ঝামেলা। কিছু করার নেই।’’

‘নির্ভেজাল’ পারিবারিক ঝামেলার জেরেই একটা আস্ত পরিবারকে পথে নামতে হয়েছে। উদ্বাস্তুর মতো ভেসে বেড়ানোর শেষ কোথায়, জানেন না শ্যামল-সোমা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shyamal Debnath SSKM Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE