বস্তাবন্দি হচ্ছে পান। —নিজস্ব চিত্র।
উৎপাদন খরচটুকুও না পাওয়ায় বাজারে পান বিক্রি করতে এসে গোছা গোছা পান ফেলে দিয়ে যেতে বাধ্য হন পানচাষিরা। পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন পানের বাজারে এমন দৃশ্য দেখা যায় হামেশাই। আলু, সব্জি, ফলের মতো পান সংরক্ষণের জন্য কোনও ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর পানচাষিদের এমন অবস্থায় পড়ার অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
পানচাষিদের দীর্ঘ দিনের এই সমস্যা মেটাতে এ বার এগিয়ে এসেছে খড়্গপুর আইআইটি। প্রায় ১৫ বছর আগে পানের বিশেষ সংরক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার হলেও বাণিজ্যিকভাবে পানের হিমঘর চালু হয়নি। ফলে গবেষণার কোনও সুফলই পাননি চাষিরা। তবে সরকারি উদ্যোগে না হলেও বেসরকারি উদ্যোগে পানের জন্য প্রথম হিমঘর চালু হল পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের নোনাকুড়ি বাজারে। এই হিমঘর চালু হওয়ায় পান চাষিদের তো বটেই পান ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের সমস্যা মিটবে বলে আশা আইআইটি’র পান গবেষকদের।
কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ধানের পাশাপাশি অর্থকরী ফসল হিসেবে রাজ্যের পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হুগলি, নদিয়া প্রভৃতি জেলায় পান চাষের রেওয়াজ রয়েছে। পান বেচাকেনার জন্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক, নোনাকুড়ি, মেচেদা, নিমতৌড়ি, রামনগর এলাকায় পানবাজার রয়েছে। রাজ্যে মূলত মিঠা, বাংলা ও সাঁচি পানের চাষ করে থাকেন পানচাষিরা। এদের মধ্যে মিঠা পানের চাহিদা বেশি। চাষিদের কাছ থেকে পান কিনে ব্যবসায়ীরা মুম্বই, চেন্নাই, দিল্লি, গুয়াহাটি-সহ তো বটেই নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশে পান রফতানি করেন। পান সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দাম হলেও পান বিক্রি করতে বাধ্য হন তাঁরা।
চাষিদের এই সমস্যার কথা জেনে পানের সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন খড়্গপুর আইআইটি’র অধ্যাপক প্রশান্ত গুহ। প্রশান্তবাবুর হাত ধরে পান সংরক্ষণের বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে প্রায় ১৫ বছর আগে। অধ্যাপক প্রশান্ত গুহর কথায়, ‘‘১৯৯৫ সাল নাগাদ মেচেদা বাজারে গিয়ে দেখেছিলাম চাষিরা দাম না পেয়ে পান ফেলে দিচ্ছেন। তা দেখেই পান-সংরক্ষণের ভাবনা শুরু। ২০০০ সাল নাগাদ পান সংরক্ষণের জন্য বিশেষ পদ্ধতির হিমঘর তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু এতদিন বাণিজ্যিকভাবে চালুর জন্য কেউ ঝুঁকি না নেওয়ায় চাষিরা এর সুফল পাচ্ছিল না।’’ কিন্তু সরকারি উদ্যোগে পান সংরক্ষণের কোনও হিমঘর চালু হয়নি। এগিয়ে এসেছেন তমলুকের এক বাসিন্দা গৌরহরি দুয়ারি। খড়্গপুর আইআইটি’র প্রযুক্তি সাহায্য নিয়ে তিনি নিজের উদ্যোগে তমলুকের নোনাকুড়ি বাজারে গড়ে তূলেছেন পান সংরক্ষণের হিমঘর। গত এপ্রিল মাসে নতুন ওই হিমঘর চালুর পর তা থেকে উপকৃত হয়েছেন এলাকার বেশ কিছু পানচাষি। ৬২ বছরের গৌরহরিবাবু নিজেও পান চাষ করতেন। জমিতে পান চাষের পাশাপাশি তাঁর বরফ তৈরির কারখানা রয়েছে। গৌরহরিবাবু বলেন, ‘‘পান বিক্রি করতে গিয়ে অনেকেই সমস্যায় পড়ে পানের দাম না পেয়ে। আইআইটি আয়োজিত কৃষিমেলায় গিয়ে পান সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কারের কথা জানতে পারি।’’
খড়্গপুর আইআইটি’র প্রযুক্তি সাহায্য নিয়ে গৌরহরিবাবু নিজের পারিবারিক জমি বিক্রি করে নোনাকুড়ি বাজারে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ঘনফুট আয়তনের একটি পান সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়েছেন। গত এপ্রিল মাসে ওই পান সংরক্ষণ কেন্দ্রের একাংশ চালু হয়েছে। প্রশান্তবাবু জানান, এই হিমঘরে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায় পান রাখা হয়। হিমঘরে ১৬ দিন পর্যন্ত পান সংরক্ষণ করে রাখা যাবে খুব কম খরচে। ফলে চাষিরা বাজারের পানের দাম কম থাকলেও এখানে পান রেখে অন্যকোন দিন পানের দাম বাড়লে বিক্রি করতে পারবে।
উপকৃত হচ্ছেন চাষিরাও। আলিনান গ্রামের পান চাষি তপন আদকের কথায়, ‘‘হিমঘর চালুর কয়েকদিন পরেই আমি বাজারে ১২০০ পান নিয়ে গিয়েছিলাম । সেদিন আমার মিঠা পানের বাজার দর দেওয়া হয়েছিল প্রতি একশো পান মাত্র ১৫ টাকা। তাতে ওই পানের উৎপাদন খরচও পাওয়া যাবেনা । এই অবস্থায় নতুন ওই হিমঘরে গিয়ে পান রেখে দিয়েছিলাম। চারদিন পরে বাজারে ওই পান প্রতি একশো ৬০ টাকা দরে বিক্রি করি।’’ পানের সংরক্ষণের এই হিমঘর চালুর উদ্যোগ নিয়ে নোনাকুড়ি শ্রীকৃষ্ণ পান ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সতীনাথ জানা বলেন, ‘‘পান সংরক্ষণের জন্য এই বিশেষ প্রযুক্তির হিমঘর তৈরির ফলে চাষি ও ব্যবসায়ীদের উপকার হবে বলেই আশা করছি। তবে সারা বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পানের চাহিদা ও উৎপাদন অনুযায়ী বাজার দর ওঠা নামা করে। তবে পান সংরক্ষণ করে তাঁর গুণগত মান বজায় থাকলে পান বিক্রির ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy