পেঁয়াজের ঝাঁঝে বেসামাল বাংলা-বাজারে শাক-সব্জির দামও চড়ছে। একশো টাকাতেও থলে ভরছে না। পটল, ঢ্যাঁড়শ, ওল, বরবটির মতো সব্জির কিলো প্রতি দর গড়ে ৪০ টাকা। উচ্ছের দামেও মেজাজ তেতো হচ্ছে ক্রেতাদের— ৪৫ টাকা কেজি!
গেল বন্যায় দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় সব্জি ক্ষতি হয়েছে। তারই জেরে বাজার এখন আগুন। বর্ধমানের বাজারে বেগুন কেজিতে ৫০ টাকা। হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের বাজারে পটল ৫০। দুর্গাপুর-হলদিয়ার মতো শিল্পাঞ্চলে সব সব্জির দরই চড়া। দুর্গাপুরের বাজারে কচুর কেজি প্রতি দর ৩০-৪০ টাকা। কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তার কথায়, “দক্ষিণবঙ্গে অতিবর্ষণের ফলে এ বার সব্জি চাষে ভাল রকমই ক্ষতি হয়েছে। বাজারে সব্জি আমদানির হার কমে গিয়েছে। সব্জি সঙ্কটে কোনও কোনও বাজারে দামের এমন ফারাক হচ্ছে।”
বর্ধমানের পূর্বস্থলীর কালেখাঁতলার রজত দস্তিদার, কালনা-২ ব্লকের জনার্দন ঘোষের মতো সব্জি চাষিদের বক্তব্য, “পটল কেজিতে ৪০-৪৫, ঢ্যাঁড়শ ৩০-৩৫, উচ্ছে ৪০-৪৫, কাঁকরোল ৪০ থেকে ৩৫, ওল ৩০, কচু ২০-৩০, লঙ্কা ৭০ টাকা দরে আড়তদারের কাছে বিক্রি করছি আমরা। বাজারে তা পৌঁছচ্ছে প্রতি কেজিতে আরও অন্তত ১০-১৫ টাকা বেশি দরে।” আবার কোথাও কোথাও অসাধু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে মতো বেশি দর হাঁকছেন বলে অভিযোগ। প্রশাসনের তরফে নজরদারির ব্যবস্থা নেই। অথচ এর জন্য সরকারি টাস্ক ফোর্স রয়েছে। গত বছর জুনে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে টাস্কফোর্সের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, খুচরো বাজার গুলিতে প্রতিদিন সব্জির পাইকারি দাম লেখার ব্যবস্থা করা হবে। যাতে ডিজিট্যাল বোর্ডে সব্জির পাইকারি দর জানা যায়। বছর ঘুরলেও সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি।
হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের বাজারে সব্জির আকাশছোঁয়া দামের জন্য অবশ্য স্থানীয় ভাবে সব্জির অভাবেই দায়ী করছেন খুচরো ব্যবসায়ীরা। মাখনবাবুর বাজারের সব্জি ব্যবসায়ী সর্বানন্দ মাইতি জানালেন, চাহিদা অনুযায়ী জোগান নেই। তাই দাম চড়ছে। এখানকার বাজারে ঘাটাল, নন্দীগ্রাম ও মহিষাদল থেকে সব্জি আসে। জুলাই-অগস্টের বানভাসি পরিস্থিতির জন্য সব্জিচাষ ব্যাপক মার খেয়েছে। এখন উত্তর ২৪ পরগনা থেকে সব্জি আমদানি করা হচ্ছে। এর ফলে, ছোট-বড় আকার অনুপাতে এখানকার বাজারে বেগুন-পটলের দাম এখন ৪০-৬০ টাকা কেজি। ভাদ্রমাসে অনেকে লাউ খান না। অন্য বছর এ সময় বাজারে লাউয়ের দাম কম থাকে। কিন্তু এ বার হলদিয়ার বাজারে লাউয়ের কেজি ২৫-৩০ টাকা। মহিষাদলের কেশবপুর জলপাইয়ের চাষি সত্যরঞ্জন জানা বলেন, “অতিবৃষ্টিতে সব্জিচাষের দফারফা অবস্থা। গত বছর চিচিঙ্গার কেজি ছিল ৭ টাকা। এ বার ২০ টাকা।’’
সব্জির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য কিছু বিক্রেতার সুযোগসন্ধানী মনোভাবকে দায়ী করেছে কৃষি বিপণন দফতর। পেঁয়াজের দাম বাড়ার উৎসাহে কিছু ব্যবসায়ী পিলে চমকানো দর হাঁকছেন। সেই কারণেই পাইকারি দরের সঙ্গে খুচরো দরের আসমান জমিন ফারাক হচ্ছে বলে দাবি। তবে যেখানে সব্জিচাষে ক্ষতি হয়নি, সেখানে তুলনামূলক ভাবে সব্জির দাম অনেকটাই কম। যেমন, উত্তর ২৪ পরগনার কিছু হাটে বাজারে পটল-ঝিঙে-বেগুনের দাম ১৫-২০ টাকার মধ্যে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, কাঁচা আনাজের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারিস্তরে পদক্ষেপ করা হচ্ছে না। পেঁয়াজেরও কালোবাজারি হচ্ছে। এক কেজি পটল পাইকরের কাছে বিক্রি করে চাষি পাচ্ছেন ২০-২২ টাকা। অথচ সেই সব্জির দাম শিলিগুড়ির বিভিন্ন বাজারে কোথাও ৪৪ টাকা কোথাও ৪৮ টাকা। মালদহের চাঁচলে কাঁচালঙ্কার খুচরো দাম ৭০ টাকা কেজি। কিন্তু চাষি পাচ্ছেন কেজি পিছু ৩৫ টাকা। সব্জিচাষিদের বক্তব্য, “যে দামে সব্জি বিক্রি করতে হচ্ছে, তাতে অনেক সময় খরচও ওঠে না।” চাঁচল বাজারের সব্জি ব্যবসায়ী শেখ কালু, মহম্মদ ইয়াসিনদের যুক্তি, “সব্জি অনেক সময় বিক্রি হয় না। নষ্ট হয়। তাই ওই ধরনের সব্জির বেশি দাম না নিলে পথে বসতে হবে।”
হলদিবাড়ি পাইকারি সব্জি ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক দিগ্বিজয় সরকার বলেন, “চাষিরা যে সব্জি আনেন তার চার ভাগের এক ভাগ খারাপ থাকে। ভালমন্দ মিশিয়ে সব্জি কিনতে হয়। যার জন্য দামে একটু বেশি তফাত থাকে।” বাজার বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, চাষির খেত থেকে কয়েক হাত ঘুরে বাজারে সব্জি বিকোচ্ছে। সেই জন্যই এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। ফড়েদের মৌরসিপাট্টা চলতে থাকলে সব্জিবাজারের আগুন নেভানো সম্ভব নয়। দিনহাটা মহকুমা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রানা গোস্বামীর কথায়, “দক্ষিণবঙ্গের বন্যার কারণে সব্জি উৎপাদন মার খেয়েছে। উত্তরবঙ্গ থেকে সেখানেও সব্জি যাচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই পাইকারি ও খুচরো দুই বাজারে সব্জির দাম এখন বেশি। শীতের সব্জি না আসা পর্যন্ত এই অবস্থা চলবে।”