সমবয়সী দু’জনের বাম রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্র জীবনেই। দু’জনেই এসএফআই করেছেন। তরুণ বয়সেই সফি সিপিএমের টিকিটে লোকসভার সাংসদ। বছরের বেশির ভাগ সময়টা দিল্লিতেই। কিছু দিন পরে তিনি যখন কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢুকছেন, সমীর ধীরে ধীরে উঠে আসছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সম্পাদক পদের দিকে। তখনকার তৈরি হওয়া দূরত্ব আবার মিলে গেল নয়ের দশকের শেষ দিকে। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় দু’জনেই সিপিএম ছাড়লেন, তৈরি করলেন নতুন দল পিডিএস। এই পর্বের ১৩-১৪ বছর নানা ওঠাপড়ায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কেটেছে দু’জনের। ক্যানসার সফিকে সরিয়ে না নিলে এই জুটির ইনিংস নিশ্চিত ভাবেই আরও লম্বা হতো। বন্ধু তো বটেই, আরও বেশি করে অন্য ধারার রাজনীতির এক দার্শনিককে হারিয়ে স্বভাবতই বিহ্বল সমীর।
গত চার বছর ধরে সফির মারণ-রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণপাত করেছেন সমীর। সফি প্রাক্তন সাংসদ থাকায় অবশ্যই চিকিৎসায় কিছু সুবিধা ছিল। এই পর্বটায় সিপিএমের কোনও ভূমিকা ছিল না। কিন্তু শেষ দিকে এসে সিপিএম নেতৃত্বেরও হয়তো মনে হয়েছিল, সফিকে হারানো গোটা বাম রাজনীতির পক্ষেই বড় ক্ষতি। শেষ কয়েক দিনে হাসপাতালে আনাগোনা বাড়িয়েছিলেন সিপিএম নেতারা। মৃত্যুর খবর পেয়ে দিল্লির বেসরকারি হাসপাতালে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন স্বয়ং প্রকাশ কারাট! ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলার যে নীতির কথা বলে দলে ব্রাত্য হয়েছিলেন সফি, কারাট ঠিক তার বিপরীত ধারার প্রবর্তক! সফিকে হারানো তাঁর কাছে বন্ধু-বিচ্ছেদ নয়। তবু শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
সমীর ভুলতে পারছেন না আরও অনেক কিছুই! দু’জনেই দু’জনের বাড়িতে থেকেছেন। ১৯৯৯ সালের অগস্টে এক জনের বাড়িতে দুই বন্ধুকে নিয়ে মিটিং করেছেন সিপিএমের ‘বিদ্রোহী’ নেতা সুভাষ চক্রবর্তী। শেষ পর্যন্ত সুভাষ অবশ্য তাঁদের সঙ্গে সিপিএম ছেড়ে বেরোননি। রাজনীতির নানা যুদ্ধে সহ-সৈনিককে হারানোর বেদনা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন সুব্রতবাবু। অধুনা তৃণমূল নেতা এবং রাজ্যের বর্ষীয়ান এই মন্ত্রীর কথায়, “প্রিয়দাকে যখন দিল্লির হাসপাতালে দেখতে গেলাম, চোখে জল এসে গিয়েছিল। ডাক্তারেরা বলেছিলেন, আপনি ডাকুন। কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকছি। আমি ডাকছি, প্রিয়দা সাড়া দিচ্ছে না এটা কোনও দিন ভুলতে পারব না!” মিলে যাচ্ছে সমীরের অনুভূতিও। পিডিএসের রাজ্য সম্পাদকের কথায়, “কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে অগস্টে শেষ বার হাসপাতালে বলল, কই সমীর এসেছো! এই এক বারই আমি দিল্লি গেলাম না। সফিও ফিরল না!”
ছাত্র রাজনীতিতে সমসাময়িক ছিলেন সফি-সমীর-নেপালদেব ভট্টাচার্যেরা। কিছুটা জুনিয়র গৌতম দেব। যদিও বন্ধুর মতোই মিশতেন তাঁরা। গৌতমবাবুর বাড়িতে বহু আড্ডা বসেছে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতমবাবু বলছেন, “সুব্রত ছিলেন স্টর্ম-ট্রুপার, প্রিয়রঞ্জন তাঁর নেতা। সমীরদা-সফি ওই রকম নয়। সমীরদা দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, সফি কলকাতায় রাজনীতি করতেন। দল ছাড়ার সময় থেকে ওঁদের বন্ধুত্ব গভীর হয়েছিল। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যে ধারার প্রতিনিধিত্ব সফি করতেন, তাতে দু’জনকে অবশ্য জুটি বলা যায়।” গৌতমবাবুরই কথায়, “সফিদা নীতি-আদর্শ নিয়ে ভাবত। সমীরদা করত সংগঠনটা। এই দু’টো দিক ওরা এক সঙ্গে কাজে লাগাত।”
সমীরের স্মৃতিতে আছে, সফি যখন দিল্লির নেতাদের চাপে লোকসভায় আর টিকিট পেলেন না, তিনি চেষ্টা করেছিলেন ডায়মন্ড হারবার থেকে তাঁকে দলের প্রার্থী করতে। আলিমুদ্দিন রাজি হয়নি। পরবর্তী কালে, বিশেষত সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে দু’জনের মতের ফারাকও হয়েছে। সমীর যদিও বলেন, “আমাদের মধ্যে বিরোধ বড় করে দেখানোর চেষ্টা কখনও কখনও হয়েছে। দলের বৈঠকে সফিই সে সব মিটিয়ে দিত। স্মৃতিতে যা আছে, আস্তে আস্তে লিখব।”
রাজনীতি থেকে এমন জুটির অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে কেন? সুব্রতবাবু বলছেন, “আমার মতে, সব ক্ষেত্রেই অবক্ষয় হয়েছে। আমরা যা করতাম, সমাজে তার প্রভাব পড়ত। এখন সমাজটারই কী অবস্থা?”
প্রিয়-সুব্রত যেমন ইতিহাস, সফি-সমীর জুটিও এখন থেকে স্মৃতির জগতের বাসিন্দা! স্মৃতিটুকু মনে রেখেই এ দিন রাতে বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন সিপিএমের নেপালদেবও। গৌতমবাবুর কথায়, “সফি ডিজাভর্স ইট!” সমীর দল ছাড়ার আগে অনিল বিশ্বাসের সেই কথাটা ‘বন্ধুর চেয়ে পার্টি বড়’ সেও কি শুধুই স্মৃতি?