Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

সুখেনের তৎপরতায় বাঁচল চার প্রাণ

সিনেমায় দেখেছিল, জলে ডুবে গেলে বুক-পিঠ মাসাজ করলে, ঝাঁকুনি দিলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রচন্ড একটা শব্দের পর আটজনকে মাঠের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ছেলেটার মাথায় এসেছিল সিনেমার সেই দৃশ্য। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের বুক পিঠ মাসাজ করতে থাকে সে। ঝাঁকুনি দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। তার দেখাদেখি গ্রামের অন্যরাও তা করতে থাকে। এ ভাবে প্রাণ বাঁচল চার কিশোরের।

এখানেই বাজ পড়ে মারা গিয়েছে গ্রামের ছেলেরা। পাশে দাঁড়িয়ে সুখেন। নিজস্ব চিত্র।

এখানেই বাজ পড়ে মারা গিয়েছে গ্রামের ছেলেরা। পাশে দাঁড়িয়ে সুখেন। নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৫ ০১:১৭
Share: Save:

সিনেমায় দেখেছিল, জলে ডুবে গেলে বুক-পিঠ মাসাজ করলে, ঝাঁকুনি দিলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রচন্ড একটা শব্দের পর আটজনকে মাঠের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ছেলেটার মাথায় এসেছিল সিনেমার সেই দৃশ্য। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের বুক পিঠ মাসাজ করতে থাকে সে। ঝাঁকুনি দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। তার দেখাদেখি গ্রামের অন্যরাও তা করতে থাকে। এ ভাবে প্রাণ বাঁচল চার কিশোরের।
রবিবার দক্ষিণ আখড়াতলায় বেতনি নদীর ধারে একটি ইটভাটা সংলগ্ন মাঠে ফুটবল খেলার সময়ে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ বাজ পড়ে মৃত্যু হয় অর্জুন সর্দার পাড়ার বাসিন্দা চার কিশোরের। তাদের নাম মিঠুন মুণ্ডা, শুভজিৎ সর্দার, অমিত সর্দার এবং নারায়ণ সর্দার। কিন্তু ওই গ্রামেরই বছর সতেরোর সুখেন সর্দার নামে এক কিশোরের উপস্থিত বুদ্ধির জেরে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে বাকি চারজন। ওই চার কিশোর-সহ ১১জন তড়িদাহত হয়ে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ কুণাল সরকার বলেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যক্তিদের বুক মাসাজ করলে সত্যিই লাভ হতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘ওই কিশোররা ছিল সুস্থ, সবল। হঠাৎ উঁচু ভোল্টেজের শক খেলে হৃদপিণ্ড গতি খুব দ্রুত, অসম গতিতে চলতে থাকে। বাইরে থেকে হঠাৎ ধাক্কা দিলে তা আবার ঠিক ছন্দে ফিরতে পারে।’’ তাঁর মতে, বুকে জোরে চাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখে ফুঁ দিলে ফল আরও ভাল হতে পারে।
অর্থের অভাবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে পারেনি সুখেন। বছর সতেরোর ছেলেটি জানায়, এ দিন তাকেও ফুটবল খেলতে ডেকেছিল বন্ধুরা। খাওয়া শেষ হয়নি বলে দেরি হয়েছিল তার। সুখেন বলে, ‘‘একটু পরেই তীব্র আলোর ঝলকানির সঙ্গে একটা বিকট শব্দ হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগে একজন চিৎকার করে বলে, বাঁধ ভেঙেছে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে জল না দেখতে পেয়ে একটু এগোতেই দেখি মাঠের মধ্যে আটজন উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। বাকিরা ভয়ে পালিয়েছে।’’
টিভিতে সিনেমা দেখে সুখেন জেনেছিল, দম আটকে গেলে বুক-পিঠ মাসাদ হয়। সেই শিক্ষাই কাজে দেয় তার। এ ভাবে জ্ঞান ফেরে বাকিদের। তবে টিভি-দেখা শিক্ষায় তার বন্ধুদের প্রাণ বাঁচাবে তা কোনও দিন ভাবতে পারেনি সুখেন।

এ দিন হাসপাতালে অসুস্থদের দেখার পর গ্রামে যান বসিরহাটের সাংসদ ইদ্রিশ আলি। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মৃত এবং আহতদের ৩৫ হাজার টাকা সাহায্য করেন।

সোমবার দুপুরে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল গোটা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এক সঙ্গে চারজনের মৃত্যুতে এলাকাটা বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনায় স্থানীয় স্কুলগুলি সব বন্ধ রাখা হয়েছে। একটা মাটির ভাঙাচোরা ঘর। বৃষ্টি আটকাতে ভাঙা টালির উপর ছেঁড়া পলিথিন দেওয়া হয়েছে বেশিরভাগ বাড়িতে। এরকমই একটি ঘরের সামনে বসে নারায়ণের মা বিশ্রী সর্দার। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি বলেন, ‘‘বলেছিলাম ভাত বেড়েছি খেয়ে যা। কথা শুনল না ছেলেটা। বলল, খেলে এসে খাচ্ছি। কাঁচা লঙ্কা আর পান্তা (জল দেওয়া ভাত) তৈরি রেখো। ভাতের থালা পড়ে রইল। কিন্তু আমার নারায়ণ আর ফিরল না।’’

ওই গ্রামেরই বাসিন্দা আরতি বিশ্বাস, মাধবী দাস, বিকাশ মণ্ডল, ইমাম গাজি জানান, রবিবার থেকেই গ্রামের মানুষের রান্না বন্ধ। অভাবের মধ্যেই বেশির ভাগ দিন কাটে এই গ্রামের মানুষের। কিন্তু গ্রামটিতে লেখাপড়ার ভাল চল আছে। মৃত চার কিশোরই স্কুলে পড়াশোনা করত।

এ দিন শুভজিতের বাড়ির সামনে পলিথিন দিয়ে মোড়া দেহগুলি রাখা ছিল। নদী চরে জল জমে থাকায় সোমবারও দেহগুলি দাহ করা হয়নি। এই গ্রামে নদী চরেই সৎকার হয়। সন্দেশখালি ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অর্চনা হালদার, বিডিও অনিন্দ্য গৌতম, স্থানীয় পঞ্চায়েতের সরমা মণ্ডল-সহ অনেকে এ দিন ওই গ্রামে যান। পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষে মৃতদের পরিবার পিছু পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আহতদের জন্য দু’হাজার টাকা দেওয়া হয়। অনিন্দ্য গৌতম বলেন, ‘‘মৃত আদিবাসী পরিবার পিছু যাতে সরকারি ভাবে আড়াই লক্ষ টাকা করে পায়, সে জন্য প্রয়োজনীয় নথি তৈরি করা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE