এ ভাবেও ফিরে আসা যায়।
এক সময় মুখে-মুখে ফেরা গানের এই কলিই যেন এখন কর্পোরেট-মন্ত্র তন্তুজ আর মঞ্জুষার।
বছর তিনেক আগেও হিসেবের খাতায় মুনাফার আঁচড় পড়ত না তন্তুজের। আর ৩৮ বছরে কখনও লাভের মুখ দেখেনি ১৯৭৮ সালে তৈরি মঞ্জুষা। বাম জমানার শেষ দিকে ওই দুই সরকারি সংস্থাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেই পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাজারের সঙ্গে পা মেলানোর অক্ষমতা, পেশাদারিত্বের অভাব আর অবশ্যই কর্মী সংগঠনের দাদাগিরি। জমানা বদলের পরে সেই ছবি পাল্টে লাভের মুখ দেখেছে দুই সংস্থা। খাদের কিনারা থেকে উঠে এসে এখন বরং কোমর বাঁধছে লম্বা দৌড়ের জন্য।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘প্রশাসনের লাগাতার চেষ্টা ও নজরদারি, শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো, পেশাদারিত্ব, বাণিজ্যিক পরিকল্পনা, এবং নিষ্ঠার দৌলতেই সম্ভব হয়েছে এই ঘুরে দাঁড়ানো।’’
তৃণমূল-সরকারের শেষ তিন বছরেই নিট লাভ করেছে তন্তুজ। ২০১৫-’১৬ সালে তাদের ব্যবসার বহর ছিল ১২৩ কোটি টাকা। মুনাফা ৩.৩ কোটি। আগামী বছর ২০০ কোটির ব্যবসা করে অন্তত ১০ কোটি টাকা লাভ ঘরে তুলতে চায় তারা। অথচ ২০১২-’১৩ সালেও ৪ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল এই সংস্থার।
মঞ্জুষা-কাহিনিও অনেকটা একই রকম। ১৯৮৬-’৮৭ সালে দেড় লাখ টাকার কার্যকরি মুনাফা ছাড়া বরাবরই তারা লোকসানে। ২০১৪-’১৫ সালেও তার অঙ্ক ছিল ২৬.৫০ কোটি টাকা। সেখানে ২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষে ৪৬.৭৫ কোটি টাকার ব্যবসা করে তাদের কার্যকরী মুনাফা ৩.৮৭ কোটি।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এই ঘুরে দাঁড়ানোর একটা কারণ বিপুল সরকারি বরাতের সহায়তা। কিন্তু সেটাই সব নয়। সঙ্গে বেড়েছে বিপণিতে পণ্য বিক্রি (তন্তুজে এক বছরে ৮ কোটি টাকার)। তা ছাড়া, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেটে পণ্য বিক্রির সিদ্ধান্তও সংস্থা দু’টিকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। ফ্লিপকার্টে এক বছরে ৪০ লক্ষ টাকার তাঁতের শাড়ি বেচেছে তন্তুজ। মঞ্জুষার ১২ লক্ষ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে স্ন্যাপডিলের হাত ধরে। আগামী দিনে বিপণি ছাড়াও ই-কমার্স থেকে বিক্রি লাফিয়ে বাড়বে বলে সংস্থার কর্তাদের আশা।
এক সময় বাংলার তাঁতের কাপড়ের সঙ্গে প্রায় সমার্থক ছিল তন্তুজ। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি লোক, বেতনের ভার, মাত্রাতিরিক্ত খরচ ইত্যাদির জেরে তা বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। দীর্ঘ দিন বকেয়া পড়ছিল কর্মীদের বেতন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায় ব্রিটিশ সংস্থা ডিএফআইডি-র অনুদানে তাকে ঢেলে সাজার চেষ্টা করে পূর্বতন বাম সরকার। উপদেষ্টা সংস্থা হিসেবে ডেলয়েটের দাওয়াই ছিল মূলত তিনটি— (১) কর্মী কমানো (২) লোকসানে চলা দোকান বন্ধ করে নতুন ব্যবসার পথ খোঁজা (৩) সার্বিক ভাবে খরচ কমানো। এ ছাড়া, সংস্থা পরিচালনায় দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব আমদানির উপরও জোর দিয়েছিল তারা। কিন্তু বাম জমানায় তা কার্যকর হয়নি। চাকা ঘোরার শুরু ক্ষমতার অলিন্দে রং বদলের পরে।
তন্তুজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রবীন রায়ের কথায়, ‘‘উপদেষ্টা সংস্থা কর্মী সংখ্যা ৬৭১ জন থেকে পাঁচশোয় নামাতে বলেছিল। ঝাঁপ বন্ধ করতে বলেছিল লোকসানে চলা দোকানের। এখন তন্তুজে কর্মী ৪২৫ জন। আগামী বছরের মধ্যে তা আরও ৫০ জন কমবে। বন্ধ করা হয়েছে লোকসানে চলা ১৭টি দোকানও। ঘুরে দাঁড়ানোর এটিই মূল চাবিকাঠি।’’ তন্তুজ কর্তা জানাচ্ছেন, ২০১৫-’১৬ সালে ৪৫ কোটি ছাড়িয়েছে বিপণি থেকে শাড়ির বিক্রি। সঙ্গে আছে ই-কমার্সের ব্যবসা।
রবীনবাবু জানান, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য পায়ের নীচে জমি পেতে সাহায্য করছে মোটা অঙ্কের সরকারি বরাত। ৭৫ কোটি টাকার বেশি এসেছে রেল, পুলিশ, স্বাস্থ্য দফতর, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরে শাড়ি সরবরাহ করে। সেই বরাত আরও বাড়ার দৌলতে আগামী বছরে ব্যবসা ২০০ কোটি ছাড়াবে বলে তাঁর আশা।
দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘আগে কার্যত দফতর চালাতেন ইউনিয়ন নেতারা। সংস্কারের কাজ হাত দিলেই শুরু হতো আন্দোলন। সেই সমস্যার মোকাবিলা করা গেছে।’’ রাজনৈতিক যোগাযোগের জন্য চাকরি পাইয়ে দেওয়ার চলও বন্ধ হয়েছে বলে অনেকের দাবি।
অনেকটা একই গল্প মঞ্জুষার ঘুরে দাঁড়ানোতেও। ম্যানেজিং ডিরেক্টর অমিত দত্ত বলেন, ‘‘চুরি আটকে, লোক ও খরচ কমিয়ে, ব্যবসা বাড়িয়ে এই ফিরে আসা। সাহায্য করেছে সরকারি বরাত পাওয়াও।’’
অমিতবাবু জানান, গত দু’বছরে স্বাস্থ্য, সমাজ কল্যাণ, কারা দফতর, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর থেকে প্রচুর বরাত মিলেছে। এ বার স্কুল শিক্ষা দফতরকে এক লক্ষ জুতো সরবরাহ করেও এসেছে মোটা টাকা। সব মিলিয়ে সরকারি বরাত বেড়েছে ৬৪%। পণ্যের কদর বেড়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার, হায়াত হোটেলের মতো জায়গাতেও।
তাঁর কথায়, ‘‘শুধু সরকারি বরাত নয়, খুচরো ব্যবসাও বেড়েছে ২৪%। এখন শাড়ি পরার চল কিছুটা কমেছে। তা পুষিয়ে দিতে ন্যাশনাল ইনস্টিটউট অব ডিজাইনের নকশা করা পোশাক বিক্রি করা হচ্ছে। ই-কমার্সেও চাহিদা মারাত্মক।’’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, দুই সংস্থাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করানোর জন্য চাপ দিতে তা চালানোর খরচ ব্যবসা থেকেই জোগাড়ের উপর জোর দিতে শুরু করেছিল রাজ্য। একই সঙ্গে, জোর দেওয়া শুরু হয় দুই সংস্থার পণ্যকে সারা দেশের বাজারে ব্র্যান্ড হিসেবে তুলে ধরতে। কড়া নজর রাখা হয়েছে অপচয় বন্ধের উপরেও। যেমন সংস্থা সূত্রের খবর, চুরি কমাতে মঞ্জুষার দোকানগুলিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তা ছাড়া, আগে শিল্পী বা সরবরাহকারীদের কাছ থেকে প্রায় সব পণ্যই নগদে কেনা হতো। তা এখন বন্ধ। ফলে রোজগার বেড়েছে। কর্মীদের বকেয়া মিটিয়েও সম্ভব হয়েছে লাভের মুখ দেখা। বছর চারেকের মধ্যে সরকারি সাহায্য ছাড়াই সংস্থা চলবে বলে তাদের দাবি।
ঠিক যেমন চলে মধ্যপ্রদেশ লঘু উদ্যোগ নিগম। এক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করা ওই নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভি এল কামতারা বলেন, ‘‘আমাদের শাড়ি-পোশাকের সরকারি সংস্থা মৃগনয়নী বছরে ৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। লাভ এক কোটি। সরকারি সাহায্য ছাড়াই।’’
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এই দৌড়েই এখন মশগুল তন্তুজ, মঞ্জুষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy