মাঝে দিন কয়েক কলকাতায় ছিলাম ঠিকই বা গত বছর কলকাতায় একটা আস্তানাও জুটেছে। কিন্তু আমি ঠিক কলকাতার হতে পারিনি। কলকাতা আমাকে এঁটো করেছে, কিন্তু ভক্ষণ করতে পারেনি।
আমার রক্তের মধ্যে মিশে রয়েছে একটা পলাশ ফুল আর একটা শিমুল ফুল। একটা ফুলের নাম বাঁকুড়া আর একটার নাম পুরুলিয়া। তবে পড়শিদের কথা বললেই আমার অন্য একটা ফুলের কথা মনে পড়ে। মটর গাছের ফুল।
যামিনী রায়ের গ্রাম বেলিয়াতোড়। হাইস্কুলের একটা দু’কামরার আবাসনে আমার জন্ম। যখনকার কথা বলছি, আশির দশকের সেই গোড়ার দিকে আমাদের পাড়ায় বসত করত মাত্র ছ’ঘর মানুষ। চারটে আবাসনে হাইস্কুলের মাস্টারমশায়দের চার ঘর আর তার পর বুড়িদিদের একটা দোতলা বাড়ির এক ঘর আরও একটু দূরে। বড় কালো পিচের রাস্তাটার ঠিক আগে, প্রবীরদা-রিনাদিদের আরও এক ঘর। বড় রাস্তার ও পারে যারা থাকত, তাদের ঠিক পড়শি বলে মনে করতাম না। ওদের একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তেমন পাত্তা-টাত্তা না দিয়ে আমরা তথাকথিত শিক্ষিত ছ’ঘর মানুষ হইহই করে বেঁচে থাকতাম।
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তক্তপোষকে মঞ্চ বানিয়ে অনুষ্ঠান করতাম, শাশ্বতী-চৈতালি দুই বোন কি না তা নিয়ে তর্ক জমে উঠত। মাঝরাত পর্যন্ত একসঙ্গে বসে দেখতাম ছ’সাত জনকে কাটিয়ে করা মারাদোনার কবিতার মতো গোল আর সন্ধে হলেই খাতা বগলে করে চলে যেতাম বুড়িদির বাবার কাছে অঙ্ক কষতে। আর প্রবল বকা খাবে জেনেও, খাতা বগলে নিয়ে বুড়িদি আসত আমার জেঠুর কাছে ইংরেজি পড়তে। বড় রাস্তার ও পারে যারা থাকত, তারাও অবশ্য শেষমেশ আমাদের পড়শি হয়ে উঠেছিল মস্ত এক ঘটনার পরে।
এক বার আমাদের আবাসনে ডাকাত পড়ল। রাত ন’টাতেই তখন আমরা খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। রাত এগারোটার আশেপাশে এসেছিল ডাকাত দল। আমাদের আবাসনের কাঠের দরজাটার উপরে টাঙ্গির কোপ মারছিল ওরা, আর আমার জেঠু পিঠ দিয়ে ঠেসে ধরে কোনও রকমে আটকে রেখেছিল দরজাটা। বাবা চিৎকার করছিল— ‘ডাকাত, ডাকাত’। শব্দ শুনে বুড়িদির বাবা, হাইস্কুলের ফিজিক্সের মাস্টারমশায় কন্দর্পপনারায়ণ শীট ওঁদের দোতলা বাড়ির ছাদে উঠে পিটিয়েছিলেন মুড়ির টিন আর সেই টিন পেটানোর শব্দে ছুটে এসেছিল বড় রাস্তার ও পারের মানুষগুলো। পালিয়েছিল ডাকাতেরা। আর এক নিমেষে বেড়ে গিয়েছিল আমাদের পাড়ার চৌহদ্দি।
পলাশ আর শিমুল ফুলের বাইরে তিন নম্বর ফুলের কথাটা বলা যাক। আমাদের সেই ছেলেবেলায় কালীদি-হোঁদলদির দাদা সৌমেনদা আর বুড়িদির দাদা বিকাশদা ছিল আমাদের ‘আইকন’। এক জন ভিন্ রাজ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত আর এক জন কৃষিবিদ্যা নিয়ে পিএইচডি করত। মাঝে-সাঝে ওরা বাড়ি আসত। তখন সে একটা ব্যাপার হতো বটে! গবেষণার কাজেই এক বার বিকাশদা মটর গাছ লাগিয়ে দিল ওদের এক টুকরো জমিতে। ওই গাছগুলোর রহস্য আমরা কিছুতেই ভেদ করতে পারতাম না। পিএইচডি যে কী বস্তু, আমরা জানতাম না। শুধু মেনে নিয়েছিলাম, ওই ল্যাকপ্যাকে সবুজ মটর গাছগুলো কোনও সাধারণ গাছ নয়, ওরা হল ‘পিএইচডি’র গাছ! ভাবতাম ওই আশ্চর্য গাছগুলো নিশ্চয়ই একদিন চমকে দেওয়ার মতো কোনও একটা ঘটনা ঘটাবে। তারপর এক দিন যখন গাছগুলোয় আশ্চর্য কিছুর বদলে ফুটল ছোট ছোট, সাদা সাদা ফুল— খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল গাছগুলো আমাদের ঠকিয়েছে।
মটর গাছের উপরে রাগ হলেও, আমাদের পাড়ার বিনয়ী ঘাসগুলোর উপরে কিছুতেই যেন আমরা রেগে উঠতে পারতাম না। ঘাসগুলোর সঙ্গে দেখা হতো বিকেলবেলায়। তখন গা ধুয়ে আমার মা আর বড়মা পাড়ার কাকিমাদের সঙ্গে ঘাসের উপরে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করত। ওদের ঘিরে থাকতাম আমরা। ক্রিকেট নিয়ে ভয়ঙ্কর তর্ক করতাম। আমার দুই দিদির এক জন আর আমি ছিলাম গাওস্করের ভক্ত। ছোড়দি ইমরান বলতে অজ্ঞান আর হোঁদলদি ছিল শাস্ত্রীর ফ্যান। গাওস্করের সঙ্গে শাস্ত্রীর লড়াই লেগে যেত। কথায় কথায় ভারী হয়ে যেত বাতাস।
টুকটাক ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাঝে-সাঝে লড়াই লেগে যেত মা-কাকিমাদেরও। কখনও-কখনও যে সেই লড়াই থেকে কটূ গন্ধ ভেসে আসত না, তা নয়। তবে সেই কটূ গন্ধকে ঢেকে দিত ঘাসের গন্ধ। আমাদের পাড়ার সেই বিনয়ী ঘাসগুলো কেমন যেন নির্মল, প্রাচীন এক প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর সাম্যগন্ধ উপহার দিত আমাদের। যে গন্ধ শত্রুতাকে বদলে দিত সন্ধিতে। যেন বলত, ঘাসের উপরে যারা এসে বসতে পারে, তারা তো পড়শি, তারা সব বৈরিতাকে বন্ধুতায় বদলে নিতে জানে।
ঝড়ে বড় গাছ লুটিয়ে পড়ে, ঘাস নয়।
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy