Advertisement
E-Paper

আনন্দ সংবাদ এল বাবার আর্তনাদেই

মোটে তিন নম্বরের ফারাক। তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা ছ’জন। তবে সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছে কোচবিহারের মাথাভাঙা হাইস্কুলের ছাত্রটি।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৬ ০৪:২৬
সৌভিক বর্মনের সঙ্গে সহপাঠীরা। হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।

সৌভিক বর্মনের সঙ্গে সহপাঠীরা। হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।

মোটে তিন নম্বরের ফারাক। তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা ছ’জন। তবে সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছে কোচবিহারের মাথাভাঙা হাইস্কুলের ছাত্রটি। সাধারণ ভাবে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে দক্ষিণের যে জয়জয়কার থাকে, তাতে ভাগ বসিয়েছে সৌভিক বর্মন। ৬৮৩ পেয়ে প্রথম হয়েছে সে। তার থেকে মোটে এক নম্বর পিছনে থেকে দ্বিতীয় হয়েছে বাঁকুড়ার তিতাস দুবে ও রমিক দত্ত আর হুগলির দেবদত্তা পাল। আরও এক নম্বর পিছনে থেকে তৃতীয় নদিয়ার শুভ্রজিৎ মণ্ডল ও বীরভূমের অনীক ঘোষ।

ছ’জনের কেউ খেলা পাগল, কেউ আবার মাঠের কোনও খবরই রাখে না। কেউ গল্পের বই পেলে পড়ার বই সরিয়ে রাখে। কেউ আবার রাজনীতির থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পছন্দ করে। ছ’জনের মধ্যে একটা বিষয়ে কিন্তু মিল রয়েছে। সকলেই জেলা স্কুলের ছাত্রছাত্রী। বড় শহরের কোনও নামীদামি স্কুল নয়, ওরা সবাই পড়েছে একেবারে সাধারণ স্কুলে।

যেমন সৌভিক। কোচবিহারের মাথাভাঙা স্কুলের এই ছাত্রটি একবারও ভাবেনি, সে প্রথম হবে। ‘‘তবে দশের মধ্যে থাকব, আশা করেছিলাম,’’ বলছিল সে। স্কুলে মার্কশিট আনতে যেতে হবে। তাই সকাল সকাল স্নানে ঢুকেছিল সে। হঠাৎই তার বাবা পরেশ বর্মনের চিৎকার। প্রথমটায় ঘাবড়ে গিয়েছিল সৌভিক, ‘‘ভেবেছিলাম, কোনও বিপদ ঘটল নাকি!’’ কোনও মতে স্নান সেরে বেরিয়ে এসেই সে বুঝে যায়, বাবার এই ‘আর্তনাদ’ আসলে আনন্দে। জোড়শিমুলি হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক পরেশবাবু তখন প্রায় আত্মহারা। কিছুক্ষণের মধ্যে মাথাভাঙায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেল খবর— মাধ্যমিকে এ বারের প্রথম এই ছোট্ট শহরের বাসিন্দা।
তার পর থেকেই বাড়িতে ভিড়। পড়শি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব...। একটু পরে এলেন একে একে
নানা দলের নেতাও। আর এল কলকাতা থেকে ফোন, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর। সৌভিককে শুভেচ্ছা জানালেন তিনি।

ভৌতবিজ্ঞান আর জীবনবিজ্ঞানে একশোয় একশো সৌভিক। এ ছাড়া বাংলায় ৯৪, ইংরেজিতে ৯৫, অঙ্কে ৯৮, ইতিহাসে ৯৮ এবং ভূগোলে ৯৮। মাথাভাঙা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চৈতন্য পোদ্দার বলেন, “সৌভিক ভাল করবে, আশা করেছিলাম। কিন্তু রাজ্যে প্রথম হবে ভাবিনি। তাই আনন্দটা আরও অন্যরকম হচ্ছে।”

সারা দিন বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকার ছেলে নয় সৌভিক। সে জানাচ্ছে, ‘‘বিকেলে খেলতে যেতাম। ক্রিকেট ও ফুটবল দুইই প্রিয়। বাড়িতে থাকলে সঙ্গী কম্পিউটার গেমস।’’

বাঁকুড়ার সিমলাপাল মঙ্গলময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী তিতাস দুবে জীবনে দ্বিতীয় হয়নি। এ বারই তাকে এক ধাপ পিছনে ঠেলে দিয়েছে সৌভিক। তবে জঙ্গলমহলের এই কিশোরী চুঁচুড়ার ঘুটিয়াবাজার বিনোদিনী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী দেবদত্তা পালের সঙ্গে যৌথ ভাবে মেয়েদের মধ্যে প্রথম। দু’জনেরই প্রাপ্ত নম্বর ৬৮২। এদের সঙ্গে এক পংক্তিতে রয়েছে দুবরাজপুর শ্রী শ্রী সারদা বিদ্যাপীঠের ছাত্র রমিক দত্ত।

তিতাস বলছিল, ‘‘পরীক্ষা ভাল দিয়েছিলাম। ফলও ভাল হবে জানতাম। তা বলে এত নম্বর পাব ভাবিনি। তাই টিভিতে নিজের নাম শুনে প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারিনি।” বাবা-মা দু’জনেই স্কুল শিক্ষক। টিভিতে ইংরাজি সিনেমা দেখতে পছন্দ করলেও রাজনীতি বা খেলা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চাওয়া তিতাস তাই বলছে, ‘‘টিভির খবরেও আমার আগ্রহ নেই। কারণ খবরে সব সময় রাজনীতির কচকচানি থাকে।’’

আর দেবদত্তা? তিতাসের মতো সে-ও ডাক্তার হতে চায়। তার দাদাও চিকিৎসক। ব্যাঙ্ককর্মী বাবা ও হাসপাতালের সেবিকা মায়ের সন্তান দেবদত্তার কথায়, ‘‘ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ডাক্তার হওয়ার। কোনও নির্দিষ্ট সময় ধরে পড়তাম না। তবে যখন পড়তে বসতাম মনোযোগ দিয়েই পড়েছি।’’ পড়াশোনার পাশপাশি গান এবং নাচেও পারদর্শী দেবদত্তা।

রমিকেরও পরীক্ষা ভাল হয়েছিল। তবে সেটা যে তাকে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে দেবে, সেটা সে বা তার পরিবারের কেউই বুঝতে পারেননি। খুশির হাওয়া গোটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন হয়েছে চাকদহের শুভ্রজিৎ মণ্ডলের বেলাতেও। মাধ্যমিকে এ বার দু’জন তৃতীয় স্থান পেয়েছে। শুভ্রজিৎ তাদের এক জন। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে-ই বড়ো। শিক্ষক বাবা এবং গৃহবধূ মায়ের নজরদারিতে দিনে দিনে নম্বর বেড়েছেই তার। তার কথায়, ‘‘দিন ৭-৯ ঘণ্টা পড়েছি। সময় পেলে টিভি দেখেছি। রবীন্দ্র সঙ্গীত, গল্পের বই, কল্পবিজ্ঞান ও হাসির বই পড়তে ভাল লাগে। ছয় জন গৃহশিক্ষক ছাড়াও, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’’ ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, জানিয়েছে শুভ্রজিৎ। এর ঠিক বিপরীতে রয়েছে আর এক তৃতীয়, রামপুরহাট জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবনের ছাত্র অনীক ঘোষ। ৬৮১ পেয়ে শুভ্রজিতের সঙ্গে সে যুগ্ম তৃতীয়। সে চায় ডাক্তার হতে।

প্রথম দশে এ বার রয়েছে ৬৬ জন। সেখানে সৌভিক ছাড়াও উত্তরবঙ্গের ১৭ জন আছে। সেই দলে সব থেকে বেশি আবার মালদহের, ৭ জন। দক্ষিণে নদিয়া থেকে প্রথম দশে সব থেকে বেশি পরীক্ষার্থী, ১০ জন। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৭২।

এই সংখ্যাতেই মঙ্গলবারটা কাটালেন নানা জেলার মানুষ। কে কত পেল, তা নিয়ে দিনভর আলোচনা। যেখানে সাফল্য, সেখানে আলোচনা বেশি। যা দেখে এক জন বলেই ফেললেন, এক দিন অন্তত ভোটকে ছাপিয়ে গেল অন্য নম্বরের কথা।

Madhyamik
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy