Advertisement
১৮ মে ২০২৪

বিদেশের জেল থেকে দেশে ফিরেও জেলেই ঠাঁই ‘নিরপরাধ’ বন্দির

তাঁর গ্রাম ছুঁয়ে বয়ে চলা নদীর বুক থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিদেশি জলদস্যু। পাকেচক্রে সেই বন্দিই এর পর ভিন্‌দেশের জেলে রইলেন বছরের পর বছর। অনে—ক দিন পরে দু’দেশের সরকারের চুক্তি তাঁকে কাঁটাতার পেরিয়ে দেশে ফিরিয়ে দিলেও নিজের গ্রামে আর ফেরা হয়নি বন্দির।

বাংলাদেশি ডাকাতের হাতে বন্দি হওয়ার আগে যেমন ছিলেন চিত্তরঞ্জন গায়েন।

বাংলাদেশি ডাকাতের হাতে বন্দি হওয়ার আগে যেমন ছিলেন চিত্তরঞ্জন গায়েন।

সোমনাথ চক্রবর্তী ও অত্রি মিত্র
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:২৬
Share: Save:

তাঁর গ্রাম ছুঁয়ে বয়ে চলা নদীর বুক থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিদেশি জলদস্যু। পাকেচক্রে সেই বন্দিই এর পর ভিন্‌দেশের জেলে রইলেন বছরের পর বছর। অনে—ক দিন পরে দু’দেশের সরকারের চুক্তি তাঁকে কাঁটাতার পেরিয়ে দেশে ফিরিয়ে দিলেও নিজের গ্রামে আর ফেরা হয়নি বন্দির।

চিত্তরঞ্জন গায়েন আজও জেগে আছেন কারাগারে। জীবন থেকে শুধু ধুয়ে গিয়েছে ১৭টা বছর।

গোসাবার কুমিরমারির চিত্ত ওই ১৭ বছর যখন বাংলাদেশের জেলে বন্দি ছিলেন, তাঁর স্ত্রী শিবানী একা সয়েছেন অচেনা পৃথিবীর যাবতীয় ঝড়। দু’টো মেয়েকে মানুষ করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। তবু আজও দৌড় শেষ হয়নি জল-জঙ্গলের গ্রামের আটপৌরে গৃহবধূর।

‘মানুষটা’ তো জেলেই রয়ে গেল!

গত ২৩ নভেম্বর দেশে ফেরা বছর পঞ্চাশের চিত্তকে এখন অনেকেই চেনে। অন্তত তাঁর নয়া বসত আলিপুর জেলে তো বটেই।

১৯৯৯ সাল। একেবারেই বিনা মেঘে বাজ পড়েছিল চিত্ত-শিবানীর সংসারে। অন্য দিনের মতোই রাতবিরেতে মাছ ধরতে বেরিয়েছিলেন চিত্ত। কিন্তু সে দিন সকাল হল, ক্রমে বেলা গড়িয়ে গেল— ফেরার নাম নেই। ঘর-বার করতে থাকা শিবানী কোনও থই পাচ্ছিলেন না। অনেক অনেক পরে কোনও ভাবে জানতে পারেন, চিত্তকে জলদস্যুরা ধরে নিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশে।

সেই দিন থেকেই শিবানীর ঘর-গেরস্থালি মাথায় ওঠে। শুরু করেন স্বামীর খোঁজ, তাঁকে ফিরিয়ে আনতে নিরন্তর লড়াই। শিবানীর দাবি, তিনি জানতে পারেন, স্বামীকে বাংলাদেশের জলদস্যুরা ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে বাংলাদেশের পুলিশের সঙ্গে তাদের গুলির লড়াই হয়েছিল। অস্ত্রশস্ত্র ফেলে চম্পট দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। পুলিশ এসে চিত্তকে ধরে এবং অস্ত্র আইনে মামলা করে তাঁর বিরুদ্ধে।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাংলাদেশেও গিয়েছিলেন শিবানী। সেখানকার জেলে গিয়ে দেখা পান স্বামীর। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম বার দেখে তো আঁতকে উঠেছিলাম। কী চেহারা হয়েছে!’’ ফিরে আসার কিছু দিনের মধ্যেই শিবানী খবর পান, বাংলাদেশের আদালতে চিত্তর শাস্তি হয়েছে, ৩০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। তার পর থেকে কখনও কখনও পুলিশ, কখনও পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কখনও দিল্লি,— চিত্তকে এ পারে ফেরানোর জন্য দোরে দোরে ঘুরেছেন শিবানী।

রুপোলি রেখা দেখা গেল দেড় দশকেরও পর। ভারত-বাংলাদেশ বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় যশোরের জেল থেকে ছাড়া পেলেন চিত্ত। তবে মুক্তি পেলেন না। চুক্তি অনুযায়ী, বাকি সাজা তাঁকে খাটতে হবে ভারতের জেলে। ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ থেকে আসার পরে এক রাত তাঁকে রাখা হয় বারুইপুর থানায়। পরের দিন থেকেই চিত্তর ঠিকানা আলিপুর জেল।

সেখানেই বাবার সঙ্গে দেখা করছেন মেয়ে-জামাইরা। মায়ের মুখে বাবার গল্প অনেক শুনেছেন মঞ্জু আর দেবিকা। গত ২৫ নভেম্বর আলিপুর জেলের ‘ইন্টারভিউ’ সেলে সেই বাবার মুখোমুখি হয়ে গল্পগুলো তাঁর মুখ থেকেই ফের শুনেছেন দুই মেয়ে।

তার পরে অবশ্য কথা বলতে পারেননি কেউ— মেয়েদের জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছেন চিত্ত। এর আগে শেষ বার যখন দেখেছিলেন, মঞ্জুর বয়স তখন ৬, দেবিকা ১। এখন দু’জনেই গৃহিণী। মঞ্জুর কথায়, ‘‘আমি আর বোন তো বাবাকে চিনিই না। বাবা কিন্তু চিনেছে।’’ ছোট মেয়ে দেবিকা বললেন, ‘‘আমার তো তখন বড় জোর এক বছর বয়স। বলতে গেলে এই প্রথম বাবাকে দেখলাম। এ যে কী আনন্দ, বলে বোঝাতে পারব না!’’ মেয়েদের আক্ষেপ, ‘‘বাবা তো অপরাধ করেনি। তা হলে দেশে ফিরেও জেলে থাকবে কেন!’’

একই প্রশ্ন শিবানীর। কিন্তু কারা দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, এমনটাই নিয়ম। ভারত-বাংলাদেশ বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি সই হয় ২০১০ সালে। তার পর থেকে একাধিক বাংলাদেশি বন্দি ও-পারে গিয়েছেন। কিন্তু ও-দেশ থেকে এ-পারে আসার তালিকা দীর্ঘ নয়। কারা দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘চিত্ত গায়েনের ঘটনা আমাদের কাছেও নতুন। চুক্তি অনুযায়ী, ওঁকে বাকি কারাদণ্ড এখানেই ভোগ করতে হবে। শাস্তি কমানো যাবে কি না— তা নিয়ে নিশ্চিত নই। তবে জেলে ভাল ভাবে থাকলে কিছু দিনের জন্য প্যারোলে ছাড়া যেতে পারে।’’

শিবানী বলছেন, ‘‘শুনেছি জেলে ভাল ভাবে থাকলে ছাড়া পেতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যেতে। ভাবছি, সেটাই করব।’’ এর মাঝে আরও এক ভয়াল ঝড় এসেছিল। আয়লা। সংসারটা সত্যিই ভেসে গিয়েছিল সেই বছর। যে কারণে চিত্তর একটা ভাল ফটোগ্রাফও নেই শিবানীর কাছে। সবই গিয়েছে আয়লার গ্রাসে।

চোখেমুখে স্পষ্ট ১৭ বছরের ক্লান্তি। শিবানী তবু আশা ছাড়ছেন না। লড়াইও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Prisoner Chittaranjan Gayen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE