বাঁধভাঙা খুশি। শুক্রবার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।
প্রথম নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন।
দ্বিতীয় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন।
তৃতীয় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন।
চতুর্থ নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন।
পঞ্চম নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন।
ষষ্ঠ নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন।
সপ্তম নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন।
প্রথম সাতটি জায়গা তো বটেই। মেধা-তালিকার প্রথম ১০টি স্থানে থাকা ৩৫ জনের মধ্যে ১৯ জন ওই স্কুলেরই! শুক্রবার সকালে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ঘোষণায় চমকে উঠেছিল শিক্ষা শিবির। তবে তাঁরাই যে সব চেয়ে বেশি চমকেছেন, মেনে নিচ্ছেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষকেরা ভাল। ছাত্রেরাও তুখোড়। ফল যে ভাল হবে, সেটা মোটামুটি জানাই ছিল ওই স্কুল কর্তৃপক্ষের। তা বলে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম-সহ ১০টি স্থানে স্কুলেরই ১৯ জন!
না, এতটা যে প্রত্যাশা করেননি, তা জানাচ্ছেন খোদ স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বামী বেদপুরুষানন্দই। কিন্তু সেটাই ঘটেছে। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ এ বারের উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম ১০টি স্থানে যে-৩৫ জনের নাম প্রকাশ করেছে, তাঁদের মধ্যে ১৯ জনই নরেন্দ্রপুরের। একটি স্কুল থেকে এত জন স্থানাধিকারী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ইতিহাসেই কার্যত নজিরবিহীন। এ দিন উচ্চ মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের পরে রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদককে ফোন করে অভিনন্দন জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
চমকের শুরু সকালেই। আনুষ্ঠানিক ভাবে ফলপ্রকাশের পরে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভানেত্রী মহুয়া দাস তখন মেধা-তালিকা ঘোষণা করছেন। প্রথম সাতটি স্থানে লাগাতার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন। তার পরেও বিভিন্ন স্থানাধিকারীর সঙ্গে ফিরে আসছে ওই স্কুলের নাম। মেধা-তালিকায় তো একটি স্কুলেরই জয়জয়কার! সংসদ সূত্রে জানা গেল, মেধা-তালিকা তৈরি হওয়ার পরে কর্তৃপক্ষও চমকে উঠেছিলেন। এমন ফল সম্ভব হল কী করে?
স্বামী বেদপুরুষানন্দ বলেন, ‘‘ফল যে এত ভাল হবে, সেটা ভাবতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, যে-সব ছাত্র এ বারের মেধা-তালিকায় আছে, দু’বছর আগে তাদের অনেকে মাধ্যমিকেও স্থান পেয়েছিল।’’ যেমন, এ বারের উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম স্থানাধিকারী বিল্বশিব বসু মল্লিক মাধ্যমিকে চতুর্থ হয়েছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিকে চতুর্থ পবিত্র প্রামাণিক সপ্তম হয়েছিলেন মাধ্যমিকে। আরও অনেকের নাম মাধ্যমিকের মেধা-তালিকাতেও ছিল বলে জানান প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘‘সব চেয়ে আনন্দের বিষয়, যে-১৯ জন এ বার উচ্চ মাধ্যমিকের মেধা-তালিকায় স্থান পেয়েছে, তাদের মধ্যে ১৭ জনই আগাগোড়া পড়াশোনা করেছে এই স্কুলে। দু’জন অন্য স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে একাদশে ভর্তি হয়েছিল এখানে। আমাদের প্রবেশিকা পরীক্ষাও খুব কঠিন। তাই তাতে সফল হয়ে যারা একাদশে ভর্তি হয়, তারাও অত্যন্ত মেধাবী।’’
ফলপ্রকাশের পরে স্কুল-চত্বরে উৎসবের মেজাজ। ছাত্র, অভিভাবক সকলেই আনন্দে আত্মহারা। হবে না-ই বা কেন! ৮০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৭৩ জনই পেয়েছেন ৯০ শতাংশের বেশি। প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘আমাদের ছাত্রেরা স্কুলের পড়াশোনার ভিত্তিতেই প্রস্তুতি চালিয়ে পরীক্ষা দেয়। তারা কোনও প্রাইভেট টিউশনে যায় না।’’
সফল ছাত্রদের কথাতেও প্রধান শিক্ষকের বক্তব্যের প্রতিফলন। মেধা-তালিকায় দ্বিতীয় স্থানাধিকারী শেখ মনিরুল মণ্ডল যেমন বলেন, ‘‘আবাসিক স্কুল বলে আমরা সকলে একসঙ্গে থাকতাম। আমাদের মধ্যে কেউ অঙ্কে ভাল, কেউ পদার্থবিদ্যায়, কেউ বা অন্য কোনও বিষয়ে। যে যে-বিষয়ের ভাল ছাত্র, আমরা সেই বিষয়টা তার কাছে বুঝে নিতাম। সেটা এই সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি।’’ এই সাফল্য যে কোনও ব্যক্তির নয়, সমষ্টির, তা জানিয়ে মেধা-তালিকার তৃতীয় স্থানাধিকারী মৃন্ময় রায়
বলেন, ‘‘পঞ্চম শ্রেণি থেকে এখানে পড়ছি। এটা বুঝেছি যে, আমাদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার নাম সহযোগিতা। আমরা ১৯ জন একসঙ্গে মেধা-তালিকার শীর্ষে থাকায় খুব আনন্দ পেয়েছি।’’
এ বারের উচ্চ মাধ্যমিকের শীর্ষে থাকা বিল্বশিবের বক্তব্য আবার বেশ চমকপ্রদ। ৫০০-য় ৪৯৬ নম্বর পেয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘স্কুলের পরীক্ষায় কোনও দিনই প্রথম তিন জনের মধ্যে থাকতাম না। উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টেও ছিলাম না। টেস্টের পরেই দিনে সাত-আট ঘণ্টা পড়তে শুরু করি। তবে এত ভাল ফল আশা করিনি।’’
নরেন্দ্রপুরের কৃতিত্বের ইতিহাস দীর্ঘ। সত্তরের দশকের শেষ এবং আশির দশকের প্রথম দিকে সাফল্যের এক নাম ছিল নরেন্দ্রপুর। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৮০, ’৮১ এবং ’৮২ সালে লাগাতার প্রথম স্থান ধরে রেখেছিল নরেন্দ্রপুর। স্কুলের প্রথম ব্যাচের (১৯৬১) ছাত্র চন্দন দাস বললেন, ‘‘আমাদের সময় থেকেই এই স্কুলের সার্বিক ফল ভাল। অতীতে অনেক বারই মেধা-তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে অনেকে। ১৯৭৬-এ উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম ও দ্বিতীয় দু’টি স্থানই পেয়েছিল নরেন্দ্রপুর। কিন্তু এমনটা কখনও হয়নি।’’
প্রাক্তন ছাত্র, স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক এবং ছাত্রদের অভিভাবক-সম শরদ মিরানি ’৫৯ সাল থেকে নরেন্দ্রপুরে আছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এত জন একসঙ্গে মেধা-তালিকায় থাকায় আনন্দ তো হচ্ছেই। কিন্তু আমাদের উপরে চাপ খুব বেড়ে গেল। অভিভাবকেরা ভবিষ্যতেও আমাদের কাছ এ বারের মতো ফল আশা করতে শুরু করবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy