Advertisement
E-Paper

পিস্তল ছুড়ে তৃণমূলে যোগ

আইনের শাসন বলে এ রাজ্যে কিছু আছে কি না, ইদানীং বহুচর্চিত এই প্রশ্নটা ফের উঠল সোমবার। এ বার মুর্শিদাবাদের কান্দিতে। এ দিন শাসক দলের কর্মিসভায় যোগ দিতে যাওয়ার মিছিলে দিশি আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে উল্লাস করতে দেখা গেল বেশ কয়েক জনকে। শোনা গেল পরপর তিনটি গুলি ছোড়ার শব্দও।

কৌশিক সাহা ও শুভাশিস সৈয়দ

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৫
পিস্তল উঁচিয়ে তৃণমূলকর্মী সব্যসাচী দাস ওরফে সন্তু (বাঁ দিকে) ও মাধব দাস ওরফে মাধু। —নিজস্ব চিত্র।

পিস্তল উঁচিয়ে তৃণমূলকর্মী সব্যসাচী দাস ওরফে সন্তু (বাঁ দিকে) ও মাধব দাস ওরফে মাধু। —নিজস্ব চিত্র।

আইনের শাসন বলে এ রাজ্যে কিছু আছে কি না, ইদানীং বহুচর্চিত এই প্রশ্নটা ফের উঠল সোমবার। এ বার মুর্শিদাবাদের কান্দিতে। এ দিন শাসক দলের কর্মিসভায় যোগ দিতে যাওয়ার মিছিলে দিশি আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে উল্লাস করতে দেখা গেল বেশ কয়েক জনকে। শোনা গেল পরপর তিনটি গুলি ছোড়ার শব্দও। পরে ওই পিস্তলধারীদের কয়েক জনকে দেখা গেল তৃণমূলের মঞ্চে। সেখানে তখন উপস্থিত জেলা তৃণমূলের নেতারা।

পুরভবনের সামনে, মহকুমাশাসকের দফতর থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বে, পুলিশের সামনেই ঘটল ওই ঘটনা। তার পর সারা দিন সংবাদমাধ্যমে বারবার মিছিলে ওয়ান শটার, ৯ এমএম পিস্তল নিয়ে নাচানাচি দেখানো হলো। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, তা চিহ্নিত করার কোনও চেষ্টাই পুলিশ করেনি। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলেই অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলবে। ঠিক যেমনটা হয়েছে সবংয়ে ছাত্র পরিষদ কর্মী খুন, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএমসিপি-র প্রকাশ্যে গুলি-বোমা বর্ষণ, ডায়মন্ড হারবারের কলেজে তাণ্ডব, নিউ জলপাইগুড়ি ফাঁড়িতে পুলিশকে মারধর— ইত্যাদি ঘটনায়। গত মাস দু’য়েকে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনার প্রতিটিতেই অভিযুক্ত তৃণমূল অথবা টিএমসিপি-র নেতা-কর্মীরা। আর প্রতি ক্ষেত্রেই বিরোধীদের অভিযোগ, পুলিশ দোষীদের ধরার চাইতে আড়াল করতে তৎপর হয়েছে বেশি। এবং শুধু বিরোধী শিবির নয়, বিচার বিভাগের তিরস্কারও কুড়িয়েছে পুলিশ। যা তাদের অভিযোগের সারবত্তাই প্রমাণ করেছে বলে দাবি বিরোধীদের। বস্তুত এ দিনই সবং-সংক্রান্ত একটি জনস্বার্থ মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট জেলা পুলিশকে ভর্ৎসনা করেছে। প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘পুলিশ বেছে বেছে লোকজন গ্রেফতার করছে না তো?’’

রাতে মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সি সুধাকর অবশ্য বলেন, ‘‘ভিডিও ফুটেজ দেখে পিস্তলধারীদের চিহ্নিত করে পুলিশ মামলা করবে।’’ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মিছিল থেকে গুলি চলেছে পুরসভা ভবনের সামনে, যা হ্যালিফক্স ময়দানে তৃণমূলের সভাস্থলের ঠিক পাশেই। মঞ্চ ও মাঠ ঘিরে মোতায়েন ছিলেন অন্তত জনা তিরিশ পুলিশ, চলছিল টহলদারিও। গুলি ছোড়ার শব্দ তাঁদের কান এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব, বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘটনার পরেও অভিযুক্তরা সভাস্থলেই উপস্থিত ছিল, পরে তাদের মঞ্চে উঠতেও দেখা গিয়েছে। তা সত্ত্বেও পুলিশ তাদের ধরল না কেন?

বিরোধী নেতাদের দাবি, শাসক দলের সমর্থক হওয়ায় পার পাওয়া যাবে, সেই সাহসেই এমন ভাবে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মিছিল হল কান্দিতে। রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘বিহারের অবৈধ অস্ত্রের পরে বিহারের বাহুবলী সংস্কৃতিরও আমদানি হল এ রাজ্যে।’’

স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, এ দিন মোট চার জনকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা গিয়েছে। তাদের মধ্যে এক জন শাসক দলের সক্রিয় কর্মী দুঃশাসন ঘোষ ওরফে লেবু। বাকিরা হলো, পেশায় ছোট গাড়ি চালক মাধব দাস ওরফে মাধু, বেসরকারি হাসপাতালের প্রাক্তন কর্মী সব্যসাচী দাস ওরফে সন্তু ও তার ভাই পার্থসারথি দাস। তারা কান্দির ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। পার্থসারথি কান্দি কমার্স কলেজের ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক। তবে সে নিজেই জানাচ্ছে যে, এখন তৃণমূল করে।

পার্থসারথির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সে বলে, ‘‘এ দিন কান্দির ১০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে মিছিল করে যারা সভায় গিয়েছিল, তারা অনেক আগে থেকেই তৃণমূল করছে। এ দিন তারা সকলেই আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে যোগ দেয়। সেই সময়ে আমি ও আমার দাদা সব্যসাচী দাসও মঞ্চে ছিলাম।’’ আগ্নেয়াস্ত্রের প্রসঙ্গ তুলতেই ফোন কেটে দেয় পার্থ।

কর্মিসভার মঞ্চে যে নেতারা ওই চার জনের হাতে পতাকা তুলে দেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডল এবং সহ সভাপতি ধনঞ্জয় ঘোষ। ধনঞ্জয়বাবু পরে বলেন, ‘‘এ দিন অনেকের হাতে পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। ভিড়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে-থাকা কেউ পতাকা নিয়েছে কি না, তা বলা সম্ভব নয়।’’ একটি ছবিতে অবশ্য উজ্জ্বলবাবুর পাশেই মঞ্চে দেখা যাচ্ছে মাধব দাসকে। উজ্জ্বলবাবু এ দিন ফোন ধরেননি।

এই ঘটনা থেকে দলের দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করেছেন তৃণমূল জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন। তাঁর দাবি, ‘‘তৃণমূলের মিছিলে এমনটা হয় না। যদি হয়েও থাকে, কান্দির কোনও গলিতে হয়েছে। আর সেটা কংগ্রেসেরই চাল।’’ জেলা নেতারা কি তা হলে মিছিলের বন্দুকধারীদের ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন? প্রশ্ন শুনে উত্তেজিত সব্যসাচীর মন্তব্য, ‘‘জেলার নেতারা যা খুশি বলুক। শেষ কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বলবেন।’’

হ্যালিফক্স ময়দানে সভা শুরু হওয়ার কথা ছিল দুপুর ১টায়। দুপুর পৌনে ১২টা নাগাদ একটি মিছিল বের হয় কান্দি পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের রূপপুর থেকে। তাতে শ’দুয়েক লোক ছিল। রূপপুর থেকে কান্দির মহকুমা সংশোধনাগার, মহকুমাশাসকের অফিস, আদালতের সামনে দিয়ে তাসা বাজিয়ে মিছিল আসে হ্যালিফক্স ময়দানের সামনে। ময়দানে না-ঢুকে মিছিল একটু এগিয়ে যায় পুরভবনের সামনে। তখনই মিছিলের সামনের সারিতে থাকা কয়েক জন নাচতে নাচতে আচমকা আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে এগোতে থাকে। সংবাদমাধ্যমকে দেখে তারা বলে, ‘‘ছবি তোলো।’’ এর কিছু ক্ষণ পরেই শোনা যায় গুলির আওয়াজ। দু’একজন আগ্নেয়াস্ত্রহাতে পুরভবনে ঢোকারও চেষ্টা করে।

মিছিলের খবর মঞ্চে পৌঁছতেই তড়িঘড়ি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে চার যুবককে নিয়ে আসা হয় সভামঞ্চের পাশে অস্থায়ী ঘরে। সভার শেষ পর্যন্ত তারা সেখানেই ছিল। তবে সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী এবং তাঁর সঙ্গে অধিকাংশ সাংবাদিক বেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকের সঙ্গে পিস্তলধারী চার জনকেও মঞ্চে ডেকে তাদের হাতে তৃণমূলের পতাকা তুলে দেওয়া হয়।

শুভেন্দু অধিকারীকে পরে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি জানা নেই।’’ তার পর অনেকটা মান্নান হোসেনের সুরেই কংগ্রেসের কোর্টে বল ঠেলে শুভেন্দুর মন্তব্য, ‘‘যা বলার কান্দির বিধায়ক তথা স্থানীয় পুরপ্রধান অপূর্ব সরকার বলবেন।’’

কংগ্রেস বিধায়ক অপূর্ব সরকারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল নেতাদের সাহসেই ভর করে ওরা এ দিন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এমনটা করেছে। পুরভবনেও ঢোকার চেষ্টা করেছে। আমি মৌখিক ভাবে পুলিশকে জানিয়েছি। ভিডিও ফুটেজ-সহ লিখিত অভিযোগও জানাব।’’

তবে পুলিশকে জানালেও শেষ অবধি তারা নড়ে বসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। বিরোধীদের অভিযোগ, এ রাজ্যে তৃণমূলের জন্য এক নিয়ম, বাকিদের জন্য আলাদা। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা তুলে ধরছেন গত বছর অগস্টে পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলিয়াবেড়ার বাহারুনায় বিজেপির সমাবেশকে। সেখানে চিরাচরিত রীতি অনুসারে তির-ধনুক নিয়ে আসেন আদিবাসীরা। সভার পরেই বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি তাপস চট্টোপাধ্যায়-সহ মোট ৩৭ জনের নামে বেআইনি ভাবে অস্ত্র নিয়ে জমায়েতের স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে পুলিশ। গ্রেফতারও করে কয়েক জনকে।

বিজেপি নেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন খোঁচা দিতে ছাড়েননি তৃণমূলকে। বিহারে জিতলে বাংলায় বিজেপি বুলডোজার চালিয়ে দেবে, রবিবার বীরভূমে তাঁর এই মন্তব্যের জন্য দলের কাছে ভর্ৎসিত হওয়ার পরে ক্ষমা চেয়ে এ দিন জয়ের বক্তব্য, ‘‘বলতে চেয়েছিলাম, মানুষ ব্যালট দিয়ে বুলডোজার চালাবে। যেখানে শাসক দল পিস্তল নিয়ে মিছিল করার পরেও পুলিশ হাত গুটিয়ে থাকে, সেখানে মানুষ আর কী-ই বা করতে পারেন?’’

তৃণমূলের মিছিল নিয়ে সোমবার বিধানসভায় সরব হন বামেরাও। সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমান স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘বেনিয়াপুকুরে তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষে এক বালক গুলিবিদ্ধ। গড়িয়ায় ওদের গোষ্ঠী সংঘর্ষে দুই নিরীহ যুবক আক্রান্ত। তার পরেই দেখলাম, তৃণমূলের ঝান্ডা আর নাইন এমএম পিস্তল নিয়ে মিছিলে উন্মাদ নৃত্য হচ্ছে! রাজ্যের যা অবস্থা, এদের জ্বালায় কেউ আর ঘর থেকে নিরাপদে বেরোতে পারবেন না!’’

kaushik saha subhashis saiyad kandi firearms tmc cadre kandi tmc rally tmc rally tmc hooligans hooligans abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy