Advertisement
০৩ মে ২০২৪

ফ্রি-তে নাকাল স্বাস্থ্য চোখ রাখছে ১৯শে

সরকারি হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষিত ‘ফ্রি চিকিৎসা’ ৭ মাসের মধ্যে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এল স্বাস্থ্য ভবনেই! রোগীর চিকিৎসা থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার, ওষুধের খরচ, শয্যার ভাড়া— সবই এখন ফ্রি রাজ্যে। আর তার জেরে হাসপাতালগুলি থেকে প্রতিনিয়ত সেই টাকা চেয়ে বার্তা আসছে।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০৪:১৩
Share: Save:

সরকারি হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষিত ‘ফ্রি চিকিৎসা’ ৭ মাসের মধ্যে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এল স্বাস্থ্য ভবনেই!

রোগীর চিকিৎসা থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার, ওষুধের খরচ, শয্যার ভাড়া— সবই এখন ফ্রি রাজ্যে। আর তার জেরে হাসপাতালগুলি থেকে প্রতিনিয়ত সেই টাকা চেয়ে বার্তা আসছে। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের ভাঁড়ে মা ভবানী। অভাবের সংসারে আর কত দিন ‘ফ্রি’ নামের এই বিলাসিতা যে চালানো যাবে, তা নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা চিন্তিত। বিভিন্ন হাসপাতালগুলির জন্য যাঁদের টাকা জোগান দেওয়ার দায়িত্ব, সেই সব স্বাস্থ্য-কর্তারা তাকিয়ে রয়েছেন ১৯ মে-র দিকে। তাঁদের বক্তব্য, তৃণমূল যদি ফের ক্ষমতায় আসে, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী কোথা থেকে অর্থের সংস্থান করেন সেটা দেখতে হবে। আর যদি সরকার বদল হয়, তা হলে নতুন সরকার এই ‘অবাস্তব ভাবনা’-কে বয়ে বেড়াবে কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন।

মুখ্যমন্ত্রীর সব ফ্রি ঘোষণার নীতিকে কেন অবাস্তব বলছেন স্বাস্থ্যকর্তারা? তাঁদের বক্তব্য, নিখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার পরিকল্পনা এবং সেই খাতে আর্থিক সহায়তা প্রদান প্রকল্পটি আদতে কেন্দ্রীয় সরকারের। বস্তুত, নিখরচায় শয্যা এবং ওষুধের খরচ দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া টাকাতেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের সেই পরিকল্পনা ‘হাইজ্যাক’ করেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে ফ্রি করে দিয়েছেন রোগীর যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষার খরচও। স্বাস্থ্য দফতরের অন্য নানা খাত থেকে টাকা নিয়ে পরীক্ষার খরচ মেটানো হচ্ছিল। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘এত দূর কোনওমতে টানা যাচ্ছিল। কিন্তু ভোটের আগে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য ঠিক করা হল, বাইরের ল্যাবরেটরিতে খুব দামি পরীক্ষানিরীক্ষা করলেও বিল মিটিয়ে দেবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল। এতেই বাঁধের মুখ পুরো খুলে দেওয়া হয়েছে। অনেক ডাক্তার রোগীদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বলছেন। তাতে ল্যাবরেটরি এবং ডাক্তার-দু’পক্ষের মুখেই হাসি। শুধু চাপটা পড়ছে আমাদের উপরে।’’ সরকারি হাসপাতালে পিপিপি মডেলে যে ল্যাবরেটরিগুলো কাজ করে, সেখানেও টাকা মেটানো যায়নি বলে তারাও এখন পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছে।

সমস্যা আরও। পেসমেকার, স্টেন্ট, হার্ট ভালভের ক্ষেত্রেও বিপুল অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। আগে শুধু দারিদ্রসীমার নীচে থাকা (বিপিএল) রোগীদের নিখরচায় ওই সরঞ্জাম দেওয়া হতো। এখন সকলেই তা পাচ্ছেন। পেসমেকার, স্টেন্ট সংস্থার সঙ্গে ‘যোগাযোগ’-এর কারণে ডাক্তারদের একাংশ প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, দামি পেসমেকার-স্টেন্ট বসাতে পরামর্শ দিচ্ছেন। ফলে সেই টাকার জোগান দিতে নাভিশ্বাস উঠছে হাসপাতালের। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য ভবনে যখন বৈঠক হয়, তখন তাঁদের মধ্যে অনেকেই মৃদুস্বরে এই অসুবিধার কথা জানানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শীর্ষ কর্তারা আমলই দেননি। এরই মধ্যে বিস্তর অনিয়মও চলছে। স্বাস্থ্য ভবনে অভিযোগ জমা পড়ছে, হতদরিদ্র রোগীর কাছ থেকে পেসমেকার বাবদ ৮০ হাজার টাকা দাবি করছেন মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন এসএসকেএমের এক চিকিৎসক।

স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘উপার্জনের ব্যবস্থা নেই। শুধু জলের মতো খরচ। ক্যাপসুল এন্ডোস্কোপির মতো আধুনিক পরীক্ষা, বাজারে যার খরচ ৪০ হাজার টাকা, এসএসকেএমে তা আট হাজার টাকায় করানো হচ্ছিল। এখন সেটা এপিএল-বিপিএল সকলেরই ফ্রি। তাই হাসপাতালে করালে দেরি হবে এই যুক্তিতে অনেকেরই পরীক্ষা করানো হচ্ছে বাইরে। ৮ হাজার টাকার পরীক্ষার জন্য ৪০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে রাজ্যকেই।’’ রোগী কল্যাণ সমিতির টাকায় এত দিন সরকারি হাসপাতালগুলির অনেক খরচই উঠে আসত। সব ফ্রি হওয়ায় সে পথ বন্ধ। এর আগে স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছিলেন, পেয়িং বে়ড থেকে চিকিৎসা ও পথ্য বাবদ স্বাস্থ্য দফতরের আয় হতো ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা। আর ২০১৫ সালে শুধু স্বাস্থ্য বিমা যোজনা থেকেই তাঁদের ২২ কোটি টাকা আয় হয়েছে। তাই টাকার অভাব হওয়ার কথা নয়। বাস্তবে গত কয়েক মাসে স্বাস্থ্য বিমা থেকে উপার্জনও তলানিতে এসে ঠেকেছে। ফলে সরকারের ঘরে এখন শুধুই খরচ, জমার তালিকা শূন্য।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪-র অক্টোবর থেকে গ্রামীণ ও জেলা হাসপাতালে পেয়িং বেড এবং আনুষঙ্গিক পরীক্ষা ও অস্ত্রোপচারের খরচ মকুব হয়ে যায়। ২০১৫-র সেপ্টেম্বরে মেডিক্যাল কলেজেও এপিএল, বিপিএল নির্বিশেষে চিকিৎসা খরচ মকুব করার কথা জানান তিনি। স্বাস্থ্য দফতরের অডিট বিভাগের আমলারা মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর মূল ভাবনাতেই ভুল ছিল।

এক অবসরপ্রাপ্ত আমলার কথায়, ‘‘সরকারর উচিত ছিল যাঁরা পরিষেবার মূল্য দিতে সক্ষম, তাঁদের কাছ থেকে বেশি করে ফি সংগ্রহ করা। তাতে যাঁদের ভর্তুকি দরকার তাঁদের নিখরচায় পরিষেবা দেওয়া যেত। এতে সরকারের কোষাগারে হাত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না, গরিবেরও উপকার হতো।’’ স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্যের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দফতরে প্রশাসন চালানোর ক্ষেত্রে অনেক কঠোর, সংযমী হওয়া জরুরি। জনমোহিনী নীতি নিয়ে চলতে গেলে তাতে আখেরে পরিষেবার মানের সঙ্গে আপস করার ভয়ই বেশি থাকে।

তাই নতুন সরকারের আমলে কী হয়, তার দিকেই আপাতত তাকিয়ে স্বাস্থ্য কর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state government Hospital Free Service
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE