স্ত্রীর চোখের সামনে থেকে ন’বছর আগে টানতে টানতে স্বামীকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। তার পরে নৃশংস ভাবে গুলি করে খুন করা হয়েছিল উত্তরপাড়র ওই যুবককে। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিল সেই সময়ের হুগলির ‘ত্রাস’ হুব্বা শ্যামল ওরফে শ্যামল দাস, তার দাদা মিহির দাস ওরফে বাচ্চু-সহ আরও কয়েক জন দুষ্কৃতী। দুষ্কৃতীদের হুমকির মুখে পড়ে ওই হত্যা-মামলায় ১৩ জন সাক্ষী বিরূপ হন। কিন্তু পিছু হটেননি নিহতের স্ত্রী। তিন সন্তানকে নিয়ে আত্মগোপন করে থেকে এত দিন আইনি লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। অবশেষে সোমবার বিচার পেলেন। পাঁচ দুষ্কৃতীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল শ্রীরামপুর আদালত।
যাকে খুনের মামলায় এ দিন পাঁচ দুষ্কৃতীর সাজা হল, উত্তরপাড়ার আদর্শনগরের বাসিন্দা, সেই শম্ভু রায় নিজেও অপরাধমূলক কাজে জড়িত ছিল। সে-ও শ্যামলের দলেই ছিল। পুলিশ জানায়, শম্ভু তার স্ত্রী মাধুরীর ইচ্ছানুযায়ী অন্ধকার জগত্ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেয়েছিল। তাই তাকে ২০০৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর খুন করা হয়।
এ দিন সাজাপ্রাপ্তেরা হল হুব্বার দাদা বাচ্চু, আফজল আলি, তুলু দফাদার, শুভেন্দু বসাক এবং শম্ভু দেবনাথ। শুক্রবার আদালতের প্রথম ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক উত্তম নন্দী ওই পাঁচ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। সে দিন চার আসামীকে হেফাজতে নিয়েছিল আদালত। বাচ্চু হাজির না হওয়ায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এ দিন আদালতে আত্মসমর্পণ করে বাচ্চু। বেনারসি বাপি এবং রবি দাস নামে দুই দুষ্কৃতী অবশ্য উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস হয়ে যায়। শুনানি চলাকালীন খুন হয় হুব্বা শ্যামল।
মামলার বিশেষ সরকারি আইনজীবী নবকুমার ঘোষ জানান, বিচারক পাঁচ জনকেই খুন, অপহরণ এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারায় যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। পাশাপাশি, প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন। অনাদায়ে আরও ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড। আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, একের পর এক সাক্ষী বিরূপ হলেও নিহতের স্ত্রী মাধুরী যাবতীয় চোখরাঙানি অগ্রাহ্য করে আদালতে দাঁড়িয়ে দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করেছেন। গোটা ঘটনা পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণনা করেছেন। মূলত তাঁর বয়ানের উপর ভিত্তি করেই প্রমাণিত হয়েছে দুষ্কৃতীদের অপরাধ।
কী হয়েছিল ন’বছর আগের সেই রাতে?
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আগে কোন্নগরের চটকল লাইনে স্ত্রী এবং ছোট ছোট তিন ছেলেকে নিয়ে থাকত শম্ভু। মাধুরী চেয়েছিলেন, স্বামী অন্ধকার জগত্ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। শম্ভুও তাই চেয়েছিল। অভিযোগ, সেই কারণেই সে শ্যামলের বিরাগভাজন হয়। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে শম্ভু সপরিবারে আদর্শনগরের ইংলিশ রোডে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করে। ১৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে শ্যামলের দলবল সেখানে চড়াও হয়।তারা দরজা ভেঙে ঢোকে। শম্ভুকে টেনে বের করে নিয়ে যায় তারা। আট মাসের শিশুপুত্রকে নিয়ে তাদের পিছনে যেতে যেতে স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার আর্তি জানাতে থাকেন মাধুরী। দুষ্কৃতীরা তাতে কান না দিয়ে শম্ভুকে স্থানীয় একটি ক্লাব সংলগ্ন মাঠে নিয়ে যায়। দু’জন তার হাত চেপে ধরে। এক জন বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় মারে। তার পরে তাঁর বুকে-পেটে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। দুষ্কৃতীরা পালায়।
ওই রাতেই উত্তরপাড়া থানায় গিয়ে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন মাধুরী। পরে তদন্তের দায়িত্ব নেয় সিআইডি। ৯০ দিনের আগেই আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। অভিযুক্তরা অবশ্য জামিন পেয়ে যায়। এক আইনজীবী জানান, মোট ২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এত দি পরে দোষীরা সাজা পাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মাধুরী।