Advertisement
২২ মে ২০২৪

বন্ধুর পিঠে বন্ধু, কুর্নিশ জানাল সমাবর্তন মঞ্চ

বইয়ের ব্যাগ বয়ে দিয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে ধরে তুলেছে। নোট সররবাহ করেছে।

সবান্ধব: মঞ্চে বন্ধুর পিঠে সুমন। —নিজস্ব চিত্র।

সবান্ধব: মঞ্চে বন্ধুর পিঠে সুমন। —নিজস্ব চিত্র।

প্রকাশ পাল
শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৮ ০২:১৭
Share: Save:

এ বার পিঠ পেতে দিলেন বন্ধু!

কলেজ-বেলায় বন্ধুরাই তাঁর সাইকেল স্ট্যান্ড করে দিয়েছে। বইয়ের ব্যাগ বয়ে দিয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে ধরে তুলেছে। নোট সররবাহ করেছে।

আর এই ২৭ বছর বয়সে, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শ্রীরামপুর শাখায় উচ্চ পদে কর্মরত সুমন চক্রবর্তীকে কলেজের সমাবর্তন মঞ্চে পিঠে করে তুলে দিলেন সেই বন্ধুই! কারণ, সুমন জিনঘটিত অসুখে আক্রান্ত। চিকিৎসার পরিভাষায় ‘মাসকুলার ডিসট্রফি’। তর্জমা করলে ‘পেশিক্ষয়’। হুইল-চেয়ারেই তাঁর অষ্টপ্রহর কাটে।

শনিবার, ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’-র আগের দিন এমনই অমলিন বন্ধুত্বের সাক্ষী থাকলেন দু’শো বছরের প্রাচীন শ্রীরামপুর কলেজের সমাবর্তনে আসা কয়েকশো প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, অতিথি-অভ্যাগতরা। সকলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানালেন। ‘বন্ধুর পিঠে বন্ধু’— ঝলসে উঠল ক্যামেরা।

যা দেখে শ্রীরামপুরের মল্লিকপাড়ার বাসিন্দা সুমন বললেন, ‘‘বন্ধুরা না-থাকলে এতটা পথ আসতে পারতাম না।’’ আর যে বন্ধু এ দিন তাঁকে মঞ্চে নিয়ে এলেন, সেই শুভজিৎ প্রামাণিক বললেন, ‘‘কলেজ থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। আজীবন এমনই থাকবে। বিপদে-আপদে আমরা পরস্পরের পাশে থাকব।’’ অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক এবং স্নাতকোত্তর শরীরবিদ্যার কোর্স কো-অর্ডিনেটর বীথিনকুমার মাজি বলেন, ‘‘জটিল রোগকে হেলায় হারিয়ে সুমনের এই সাফল্য কলেজকে গর্বিত করেছে। অন্যেরা ওঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হবেন।’’

ছেলেবেলায় সুমন আর পাঁচজনের মতোই খেলাধুলো করতেন। কিশোর বয়সে রোগটা ধরা পড়ে। দৌড়তে, সিঁড়ি ভাঙতে, বেশিক্ষণ হাঁটতে কষ্ট হত। হাত-পায়ে জোর পেতেন না। ক্রমে রোগ জাঁকিয়ে বস‌ে। খেলাধুলো বন্ধ হয়। তবে শ্রীরামপুর কলেজে শরীরবিদ্যা অনার্স নিয়ে বিএসসি পড়ার সময়েও কষ্ট করে সাইকেল চালাতে পারতেন‌। ২০১৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি পাশ করেন। ২০১৫ সালে ওই কলেজেই মানব-শরীরবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করেন‌ ৮০.৩% নম্বর পেয়ে। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। সর্বভারতীয় পরীক্ষাতেও দুর্দান্ত ফল করেন।

এই পথ অবশ্য মসৃণ ছিল না। শারীরিক ক্লেশ কাহিল করেছে। ডাক্তার দেখানোর জন্য কলেজ কামাই হয়েছে। মানসিক যন্ত্রণাও কম ছিল না। স্নাতকোত্তরে পড়ার সময় থেকে চলাফেরার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। কোনও কিছুই অবশ্য দমাতে পারেনি তাঁকে। এ জন্য বাবা-মা, জ্যাঠা-জ্যেঠিমার পাশাপাশি পাড়ার এবং কলেজের বন্ধুদেরও কৃতিত্ব দিতে চান তিনি। শুভজিৎ ছাড়াও অলি বন্দ্যোপাধ্যায়, পাড়ার বন্ধু বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলতেও ভোলেন না সুমন। তাঁর কথায়, ‘‘দেশের বিভিন্ন নামী হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এই রোগের চিকিৎসা নেই। কী আর করব! মানিয়ে নিয়েছি। বন্ধুরাই কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে।’’

শনিবার ওই কলেজে শরীরবিদ্যা ছাড়াও উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগেরও যৌথ স্নাতকোত্তর সমাবর্তন অনুষ্ঠান হল। ছাত্রছাত্রীদের মানপত্র দেওয়া হয়। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শীর্ষ স্থানাধিকারী গৌতমী নায়ডুকে উইলিয়াম কেরি স্বর্ণপদক এবং দ্বিতীয় মৌপ্রিয়া মণ্ডলকে রৌপ্যপদক দেওয়া হয়। অতিথি হিসেবে এসেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স টেকনোলজি অ্যান্ড এগ্রিকালচার’ বিভাগের সচিব অমিত রায়, কলকাতার ‘ইনস্টিটিউট অব পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর ফার্মাকোলজি বিভাগের শিক্ষিকা মিতালি চট্টোপাধ্যায়। অধ্যক্ষ ভ্যানস্যাংগ্লুরা পড়ুয়াদের শপথবাক্য পাঠ করা‌ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Muscular dystrophy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE