কোথাও দৌরাত্ম টোটোর, রুট ভেঙে চলা অটো। কোথাও আবার দাপট ট্রেকারের। অথচ নিয়ন্ত্রণ নেই প্রশাসনের। বেড়ে চলা ছোট গাড়ির রমরমায় হুগলির জেলায় সঙ্কটে বাসশিল্প। গত কয়েক দিনে জেলার একাধিক রুটের বাস বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা। জেলা জুড়ে লাগাতার বাস ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছে জেলা বাস মালিকদের সংগঠন।
বাস মালিকদের অভিযোগ, পেশা বাঁচাতে বার বার তাঁরা সরকারের বিভিন্ন দফতরে গিয়ে জুতোর সুকতলা খুইয়ে ফেলেছেন। কিন্তু প্রশাসনের আশ্বাস ছাড়া আর কিছু মেলেনি। রাস্তায় বেঁচে থাকতে আপাতত বাস বন্ধের পথে হাঁটতে শুরু করেছেন কিছু রুটের বাস মালিকরা। দিন পনেরো ধরে মগরা-কোলরা রুটের (৪৫ নম্বর রুট) বাস বন্ধ। মঙ্গলবার থেকে একই পথ ধরেছে ৪ নম্বর (চুঁচুড়া-মেমারি) এবং ৮ নম্বর (চুঁচুড়া-কালনা এবং চুঁচুড়া জিরাট) রুটের বাস মালিকরা। এই জেলায় বাস পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের বক্তব্য, বেআইনি গাড়ির বিরুদ্ধে অবিলম্বে কড়া ব্যবস্থা না নিলে বেশ কয়েকটি রুটের বাস পাকাপাকি ভাবে ‘বন্ধ রুটের তালিকা’য় নাম লেখাবে। জেলা বাস-মিনিবাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অজিত খাঁয়ের ক্ষোভ, ‘‘জেলা প্রশাসনের ভ্রান্ত নীতির জন্য গত কয়েক বছরে এই জেলা থেকে বহু বাসরুট চিরতরে উঠে গিয়েছে।’’
জেলা পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত কয়েক বছরে ৫, ৬, ৭, ১৯, ৩৪ এবং ১২এ রুট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ১, ২, ৩, ৪, ৪৫-সহ অনেকগুলি রুটে বাসের সংখ্যা হু হু করে কমেছে গত পাঁচ বছরে। বাস মালিক সংগঠনের বক্তব্য, হুগলির চার মহকুমার মধ্যে শ্রীরামপুর, চুঁচুড়া এবং চন্দননগরে এই শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। ৪ নম্বর রুটের বাসমালিক সংগঠনের সম্পাদক পার্থ রায় বলেন, ‘‘আমাদের রুট ৫২ কিলোমিটার। তার মধ্যে ৪৭ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক। অথচ এখানে অসংখ্য বেআইনি গাড়ি যাত্রী পরিবহণ করছে। বাস চালিয়ে লাভ হচ্ছে না।’’ জেলা পরিবহণ দফতরের কর্তারা মনে করেন, স্বল্প দূরত্বের বাসরুটে এমনিতেই যাত্রী সংখ্যা কমছে। সাধারণ মানুষ অটো-টোটো বেশি পছন্দ করছেন বলে।
কেন এই পরিস্থিতি?
একটা সময় গ্রামেগঞ্জে তো বটেই, শহরাঞ্চলেও বাসের উপরেই নির্ভর করে থাকতে হতো সাধারণ মানুষকে। কম দূরত্বে অটো চলত। ট্রেকারের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তা-ও সব রুটে নয়। পরবর্তী কালে শুরু হয় রুট ভাঙা অটোর দাপট। অভিযোগ, একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতার মদতে যেখানে সেখানে অটো-চলাচল শুরু হয়। ঘটনা হচ্ছে, জেলার বহু জায়গাতেই পারমিটহীন অটোর রমরমা। গ্রামেগঞ্জের রুটের পারমিট থাকলেও বাড়তি রোজগারের জন্য তারা ছুটে বেড়ায় শহরে। এর পাশাপাশি বাসের রোজগার কমিয়েছে ট্রেকার। ক্ষমতার চেয়ে ট্রেকারে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হয় আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। বাস মালিকদের অভিযোগ, পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকে জেলা পরিবহণ দফতর। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো অভিযান হয়। দিনের পর দিন এটাই চিত্র কলকাতার কাছের এই জেলার। বছর খানেক ধরে টোটো আসায় লোকসানের ষোলো কলা পূর্ণ হয়েছে। জিটি রোড-সহ প্রায় প্রতি জায়গাতেই বাস রুটের উপর দিয়ে সমান্তরাল ভাবে শ’য়ে শ’য়ে টোটো চলছে। ৩ নম্বর রুটের এক বাসকর্মীর প্রশ্ন, ‘‘টোটো এবং বেআইনি গাড়িকে সমৃদ্ধ করতে কেন বাসকর্মী ও তাঁদের পরিবারকে ভাতে মারা হচ্ছে? বাস চালিয়ে ডাল-ভাত জোগাড় করাও আমাদের কাছে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’’
এই সমস্যা মেটাতে সোমবার জেলা বাসমালিক সংগঠনের তরফে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) কৌশিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করে সমস্যার কথা জানান তাঁরা। বুধবার চুঁচুড়ায় সংগঠনের কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন জেলার বিভিন্ন রুটের বাস মালিকরা। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রশাসনের তরফে বেআইনি গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডাকা হবে। অজিতবাবু বলেন, ‘‘যে ভাবে চলছে, লাগাতার ধর্মঘট ডাকা ছাড়া হয়তো আমাদের সামনে অন্য কোনও পথ খোলা থাকবে না।’’
জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ অধিকর্তা সুজয় সাধু বলেন, ‘‘রুট ভেঙে চলা গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। গত দু’দিনে বেশ কয়েকটি গাড়ি ধরাও হয়েছে। টোটো যাতে শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে চলে, সে ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। সীমিত পরিকাঠামো নিয়ে এই জেলায় যথেষ্ট ভাল অভিযান চালানো হচ্ছে।’’ তাঁর আশ্বাস, ‘‘বাসমালিক এবং কর্মীদের সমস্যাটা বাস্তব। আমরা সহানুভূতির সঙ্গেই তা মেটানোর চেষ্টা করছি। কারণ, ধর্মঘট হলে সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়বেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy