চুঁচুড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরাফিল হোসেন। ছবি: তাপস ঘোষ।
রাতের অন্ধকারে মাটির বস্তা ফেলে একটি গাড়ি আটকে চালককে গুলিতে খুন এবং সওয়ারি ঠিকাদারকে বেধড়ক মারধর করে তাঁর টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে ঘিরে বুধবার রাত থেকেই তেতে উঠল পান্ডুয়া। তার আঁচ পড়ল বৃহস্পতিবারেও। নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে এবং দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের দাবিতে এ দিন দুপুরে কয়েক ঘণ্টা অবরোধও করলেন গ্রামবাসীরা। শেষ পর্যন্ত পুলিশ দোযীদের দ্রুত গ্রেফতারের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
বছরের শুরু থেকে হুগলি জেলার নানা প্রান্তে শুরু হয়েছে দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্য। ডাকাতি, লুঠপাট, খুন-জখম কিছুই বাদ নেই। বুধবার রাতে পান্ডুয়ার অরলডাঙ্গা গ্রামের ওই ঘটনা সেই তালিকায় নতুন সংযোজন।
নিহত চালকের নাম নবান বাউলদাস (৪০)। তাঁর বাড়ি পান্ডুয়ারই দাবড়া গ্রামে। আহত ঠিকাদার, ওই গ্রামেরই বাসিন্দা আরাফিল হোসেনকে চুঁচুড়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। গাড়িটি তাঁরই। তবে, শুধুই ছিনতাইয়ের জন্য এই হামলা কি না, তা নিয়ে পুলিশ ধন্দে। আহত আরাফিল কথা বলার অবস্থায় নেই। কোনও পুরনো শত্রুতার জেরে তাঁকে খুন করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তাঁর চালকের গায়ে লাগল কি না, সে প্রশ্ন যেমন তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে, তেমনই এই প্রশ্নও থাকছে— হাতের নাগালে পেয়েও দুষ্কৃতীরা কেন শুধু মারধর করে ঠিকাদারকে ছেড়ে দিল! চালকের কারও সঙ্গে কোনও শত্রুতা ছিল কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। অন্ধকারে হতাহতদের পরিবারের লোকেরাও।
তদন্তকারীরা একটি বিষয়ে নিশ্চিত, রাতে আরাফিল যে ওই পথ ধরেই প্রতিদিন ফিরতেন, সে কথা দুষ্কৃতীরা জানত। সেই কারণেই তারা সেখানে ওৎ পেতেছিল। তবে দুষ্কৃতীদের সঙ্গে কোনও গাড়ি ছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী জানিয়েছেন, দুষ্কৃতীদের ধরতে পুলিশের একটি বিশেষ তদন্তকারী দল তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চলছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে রামেশ্বরপুরে আরাফিলের অফিস রয়েছে। বুধবার রাত ১০টা নাগাদ সেখান থেকেই তিনি গাড়িতে ফিরছিলেন। গাড়িটি অরলডাঙা পৌঁছতেই চালক নবান দেখেন, মাটির বস্তা ফেলে রাস্তা আটকানো। তিনি গাড়ির গতি কমান। আর তখনই তখনই গাছের আড়াল থেকে ছুটে আসে গুলি। পর পর দু’টি। একটি গুলি নবানের ডান দিকের ঘাড় ফুঁড়ে দেয়। অন্যটি লাগে তাঁর ডান হাতে। গাড়িতেই নেতিয়ে পড়েন তিনি। হকচকিয়ে যান আরাফিল। তিনি গাড়ির পিছনের আসন থেকে নামতেই জনা সাতেক দুষ্কৃতী তাঁকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর করে কয়েক হাজার টাকা ও কাগজপত্রে ভরা ব্যাগ নিয়ে পালায়।
মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েও চিৎকার করতে থাকেন আরাফিল। গুলির আওয়াজ এবং তাঁর চিৎকারে স্থানীয়েরা ছুটে আসেন। নবান ও আরাফিলকে পান্ডুয়া গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা নবানকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ তড়িঘড়ি দেহটি থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাতে গ্রামবাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। থানায় দেহটি নিয়ে যেতে বাধা দেন তাঁরা। নিহতের বাড়ির লোকজন সেখানে আসার আগেই কেন পুলিশ দেহটি থানায় নিয়ে যেতে চাইছে, সেই প্রশ্ন তুলে বিক্ষোভ শুরু হয়। হাসপাতালে গোলমালের আশঙ্কায় লাগোয়া তিনটি থানার ওসি বিশাল বাহিনী নিয়ে চলে আসেন। শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের বুঝিয়ে রাত দু’টো নাগাদ পুলিশ দেহটি নিয়ে যায় ময়না-তদন্তের জন্য। আরাফিলকে চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে স্থানান্তরিত করানো হয়।
আরাফিলের ভাই আবসার আলি বলেন, ‘‘দাদার উপরে কেন হামলা হল বুঝলাম না। দাদার কারও সঙ্গে শত্রুতা ছিল না।’’ স্ত্রী, এক ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে নিহত নবানের সংসার ছিল। তাঁর মেয়ে রীতা এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ছেলে দেবাশিস উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। এই ঘটনার পরে তারা কী ভাবে পরীক্ষা দেবে, দু’জনের কেউ-ই ভেবে পাচ্ছে না। দেবাশিস বলে, ‘‘রাতে আমি আর বোন পড়ছিলাম। তখনই খবরটা পাই। বাবাই বাড়িতে একমাত্র রোজগার করতেন। কিছু ভেবে পাচ্ছি না। কী করে যে কী হয়ে গেল…।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy