প্রদীপ নন্দী।
শনিবার গোঘাটে জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া দু’জনের মধ্যে নবম শ্রেণির ছাত্র প্রদীপ নন্দীর মৃতদেহ রবিবার উদ্ধার হলেও এ দিন রাত পর্যন্ত কোনও খোঁজ মেলেনি মুল্লুক গ্রামের কাজল ঘোষের।
রবিবার দুপুর ১টা নাগাদ জয়রামবাটির কাছে হলদি খালে প্রদীপের দেহ উদ্ধার করেন স্থানীয় মানুষ। কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র প্রদীপের বাড়ি কামারপুকুর সংলগ্ন মুকুন্দপুরে। পুলিশ দেহটি ময়নাতদন্তে পাঠিয়েছে। প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় কলকাতা থেকে যে ডুবুরি বা উদ্ধারকারী দল আসার কথা ছিল, এ দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত তাঁরা না পৌঁছনোয় এলাকায় ক্ষোভ দেখা যায়। পরে দুপুর আড়াইটে নাগাদ ৭ জনের একটি দল পৌঁছয়। কিন্তু বিকাল ৪টে পর্যন্ত স্পিড বোট না আসায় ডুবুরিরা উদ্ধার কাজে নামতে পারেননি।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার বিকাল ৩টে নাগাদ কামারপুকুরে প্রাইভেট টিউশন ছিল প্রদীপের। স্কুলে থেকে বাড়ি ফিরে ভাত খেয়েই সে মায়ের কাছে আব্দার করেছিল, কোনওদিন বন্যা দেখেনি, তাই একবার দেখে এসে টিউশন পড়েত যাবে। পেশায় দিনমজুর বাবা দিলীপ নন্দী কাজে বেরিয়েছিলেন। মা উমাদেবীর কথায়, ‘‘ছেলেকে বলেছিলাম, এখন দুপুর ২টা বাজে। ১০-১৫ মিনিট পরেই চলে আসবি।’’ এর পরেই প্রদীপ তার পিসতুতো দাদা বাপ্পা নিমুর সঙ্গে বন্যা দেখতে বেরিয়ে যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আদিবাসীপাড়ার বাদল মুর্মু, কালিচরণ বাস জানান, ওই দু’জন সাইকেল নিয়ে প্রথম চাতালটি (জল বেরিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তার নিচু অংশ) পেরিয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় চাতালে নামার সময় প্রদীপ ও তার দাদা স্রোতের ধাক্কা সামলাতে না পেরে জলে পড়ে গিয়ে তলিয়ে যায়। বাদলবাবু বলেন, ‘‘চোখের সামনে একজনকে তলিয়ে যেতে দেখে আমরা ঝাঁপ দিয়ে ধরার চেষ্টাও করি। কিন্তু একবার হাতটা দেখা দিয়েই হারিয়ে গেল। অন্যজনকে কোনওরকমে উদ্ধার করা হয়।’’
অরূপ পাল, প্রশান্ত সিংহ ও লক্ষ্মীকান্ত ভুঁইয়া।
কাজলবাবুকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন এঁরাই। ছবি: মোহন দাস।
এ দিন প্রদীপের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল ছেলের এমন মৃত্যতে মা-বাবা শোকস্তব্ধ। তাঁদের ঘিরে রয়েছেন প্রতিবেশীরা। মাঝেমধ্যেই জ্ঞান হারাচ্ছেন না উমাদেবী। ছোট ছেলে সুদীপকে আঁকড়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে দিলীপবাবু। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। প্রদীপের ভেসে যাওয়ার খবরের রেশ কাটতে না কাটতেই বিকাল ৪টা নাগাদ দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ঘটে। একই ভাবে ভেসে যান মুল্লুক গ্রামের কাজল ঘোষ। জলের তোড়ে একজনের (প্রদীপের) ভেসে যাওয়ার খবর পেয়ে চিন্তিত কাজলবাবু বেঙ্গাই কলেজের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার্থী মেয়ে পিউ ঘোষকে আনতে বের হন। কামারপুকুর-বদনগঞ্জ রাস্তায় সাতবেড়িয়া গ্রাম লাগোয়া একটি চাতাল পার হয়ে কামারপুকুরের দিকে আসতে হয়। কাজলবাবু মেয়ে এবং তাঁর পাঁচ সহপাঠীকে নিয়ে হাত ধরাধরি করে চাতালটি পার হচ্ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রবল স্রোতে বারবার বেসামাল হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। তারই মধ্যে আচমকাই সবাই একসঙ্গে জলে পড়ে গিয়ে তলিয়ে যেতে থাকেন। স্থানীয় তিন যুবক জলে ঝাঁপিয়ে এক ছাত্র এবং চার ছাত্রীকে উদ্ধার করতে পারলেও হদিস পাওয়া যায়নি কাজলবাবুর। অসুস্থ পিউকে আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ দিন হাসপাতালে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে পিউ বলেন, ‘‘এক বয়স্ক মহিলা পড়ে যাচ্ছেন দেখে আমরা তাঁরও হাত ধরতে যাচ্ছিলাম। তখনই সবাই মিলে বেসামাল হয়ে জলে পড়ে যাই। কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের উদ্ধার করলেও বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।’’
জীবন বিপন্ন করে পাঁচজনকে জল তেকে উদ্ধার করতে পারলেও কাজলবাবুকে উদ্ধার করতে না পারায় মুষড়ে পড়েছেন সাতবেড়িয়ার অরূপ পাল এবং সুবীরচকের প্রশান্ত সিংহ এবং লক্ষ্মীকান্ত ভুঁইয়া। পেশায় সকলেই দিনমজুর। শনিবার সকাল থেকেই এঁরা পয়সার বিনিময়ে সাতবেড়িয়ার চাতাল পারাপার করাচ্ছিলেন। বছর বিয়াল্লিশের অরূপ পাল এ দিন বলেন, ‘‘অনেকেই নিজেদের মতো করে পার হচ্ছিলেন। কেউ কেউ আমাদের সাহায্য চাইছিলেন। হঠাৎ দেখি ৬ জন হাত ধরাধরি করে পার হচ্ছেন। আমরা তখন সবে এ পারে কয়েক জনকে নিয়ে এসেছি। হঠাত্ দেখি ওদের সবাই জলে উল্টে পড়ে ভেসে যাচ্ছে। আমরাও কয়েকজন ওদের বাঁচানোর জন্য সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিই।’’
লক্ষ্মীকান্ত ভুঁইয়া বলেন, ‘‘সবাই হাবুডুবু খাচ্ছিল। মরিয়া চেষ্টা করে ৫ জনকে তুলে আনতে পারলেও ভদ্রলোককে খুঁজে পেলাম না।’’ প্রশান্তবাবুর কথায়, ‘‘ওঁকে উদ্ধার করতে পারলাম না বলে খুব খারাপ লাগছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy