Advertisement
E-Paper

মৃত্যু-মহল্লা হুগলির শিল্পাঞ্চল

বুধবার আত্মঘাতী হয়েছেন চন্দননগরের গোন্দলপাড়া জুটমিলের শ্রমিক বিক্রম চৌধুরী। তার আগে একই পথ বেছে নিয়েছিলেন ওই মিলেরই শ্রমিক বিশ্বজিৎ দে। অন্যেরা লড়ছেন দাঁতে দাঁত চেপে। সেই লড়াইয়ে শামিল পরিবারের সকলে। 

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৩
সুনসান: বন্ধ গোন্দলপাড়া জুটমিল। ছবি: তাপস ঘোষ

সুনসান: বন্ধ গোন্দলপাড়া জুটমিল। ছবি: তাপস ঘোষ

পুজোর বেশি দিন বাকি নেই। সকলে যখন নতুন সাজে সেজে উঠতে ব্যস্ত, হুগলি শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক মহল্লাগুলিতে তখন ঘরে ঘরে ‘চোখের জল’।

বুধবার আত্মঘাতী হয়েছেন চন্দননগরের গোন্দলপাড়া জুটমিলের শ্রমিক বিক্রম চৌধুরী। তার আগে একই পথ বেছে নিয়েছিলেন ওই মিলেরই শ্রমিক বিশ্বজিৎ দে। অন্যেরা লড়ছেন দাঁতে দাঁত চেপে। সেই লড়াইয়ে শামিল পরিবারের সকলে।

ওই ‘লড়াকু’ মানুষগুলোরই একজন পুনম দাস। স্নাতক যুবতীর বাড়িতে রয়েছেন মা এবং তিন বোন। তাঁদের সব দায়িত্বই পুনমের কাঁধে। ভোর হতেই গোন্দলপাড়া শ্রমিক বস্তির মিল মহল্লা থেকে বের হন পুনম। সম্বল ছাত্র পড়ানো। বাবা নন্দকিশোর দাস ক্যানসারে মারা গিয়েছেন কয়েক মাস আগে। মিল-মালিকের থেকে বাবার গ্র্যাচুইটির পাওনা এখনও অন্তত দেড় লক্ষ টাকা। চন্দননগর শ্রম দফতরে মামলা ঝুলছে। বকেয়া সেই টাকা কবে মিলবে কেউ জানেন না।

উত্তরপাড়ার হিন্দমোটর কারখানা বন্ধ ২০১৪ সাল থেকে। অন্তত চারশো মানুষ এখনও শ্রমিক আবাসনে বাস করছেন। আলো, জল কিছুই নেই। তবু ঠাঁই নাড়া হতে পারছেন না মানুষগুলো। কাজ নেই। রোজগার নেই। প্রায়ই চুরি হয়ে যাচ্ছে বন্ধ হিন্দমোটর কারখানার যন্ত্রাংশ। খেদের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন হিন্দমোটরের এক প্রাক্তন শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের কি কিছুই করার নেই? এত শিল্প সম্মেলন হচ্ছে, কাউকে ডেকে এই কারখানা দেখানো গেল না? ভারতের প্রথম এই মোটরগাড়ি কারখানায় এক সময় সোনা ফলত। ২৫ হাজার মানুষ কাজ করতেন। বামেরাই বা কী করল!’’

বাম শ্রমিক সংগঠনের নেতা, প্রাক্তন সাংসদ শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করিনি, তা ঠিক নয়। কিন্তু কথা শুনছে কে? সিটুর তরফে উত্তরপাড়া থানায় হিন্দমোটর কারখানার মালপত্র চুরির জন্য এফআইআর করা হয়েছে। শ্রমমন্ত্রীর কাছে গিয়েছি। স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু পুলিশ শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’’

একই হাল গঙ্গা পাড়ের সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানার অফিসার্স কোয়ার্টারের। ওই কারখানা চত্বর এখন নেশাড়ুদের আড্ডা। কোয়ার্টারের ঝাঁ চকচকে দেওয়াল আজ আগাছায় ভর্তি। গঙ্গা লাগোয়া অফিসার্স কোয়ার্টারের মালপত্র দুষ্কৃতীরা নৌকা করেও চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। এক সময় কারখানায় উৎপাদন চালুর দাবিতে, ‘ডানলপ বাঁচাও কমিটি’ গড়ে জিটি রোডে স্থায়ী ম্যারাপ বেঁধে বসে থাকতেন শ্রমিকেরা। ভোটের মুখে চক্রাকারে রাজনীতির তর্জা জমে উঠত। বাম থেকে ডান— ডানলপ খোলার দাবিকে সামনে রেখে ভোট বৈতরণী পার হতেন। এখন শ্রমিক মহল্লায় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের লোকজনই প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘রাজ্য সরকার তো অধিগ্রহণ করল। তা হলে এখনও কেন শ্রমিকেরা বকেয়া পেলেন না? সরকারের কি সেই নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত নয়?’’

পুজোর মুখে এক সময় কিন্তু ‘ডানলপ বাঁচাও কমিটি’ বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের চাল-ডাল দিয়ে কিছুটা হলেও দায় নিতেন। এখন তাঁরাও ফিরে তাকান না। শুধু ডানলপ নয়, বড় শ্রমিক সংগঠনগুলি দায় এড়িয়েছেন হুগলির বন্ধ জুটমিল মহল্লা নিয়েও। ক’দিন আগেই শ্রীরামপুর ইন্ডিয়া জুটমিলের গেটে মাছি তাড়াচ্ছিলেন এক চা-ওয়ালা। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘১৬ মাস ধরে কারখানা বন্ধ। চা-বিস্কুটেও ধার হয়ে যাচ্ছে।’’

শ্রমিক-নেতারা না পারলেও রাস্তায় নেমেছেন চন্দননগরের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্রের মতো একাধিক সংগঠন। নিয়ম করে বন্ধ গোন্দলপাড়া জুটমিলের শ্রমিক তারা চাল-পোশাক দিচ্ছে। সপ্তাহে দু’দিন করে চন্দননগরে মেডিক্যাল ক্যাম্প চালু করেছে। শহরের নামী ডাক্তারেরা পরিষেবা দিচ্ছেন। নিখরচায় মিলছে ওষুধ। এমনকি, বিশেষ ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা মিলছে বাচ্চাদের পড়াশোনায়। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের পিএফ, গ্র্যাচুইটির বকেয়া টাকা নিয়ে শ্রম দফতরে মামলা করছে তারা।

Hoogly Jute Mill Industrial belt of Hoogly
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy