রাত সাড়ে ১১টা। ইডেনে কলকাতা নাইট রাইডার্স ও রয়াল চ্যালে়ঞ্জার্স অব বেঙ্গালুরুর শেষ মুহূর্তের খেলা চলছে। সোমবার ক্লাবের দোতলার ঘরে তখন টিভিতে খেলা দেখতে মগ্ন জনা পনেরো সদস্য। আচমকাই কেউ একজন ওই ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করার চেষ্টা করলো। তার পরেই গুলির শব্দ।
সদস্যদের কয়েকজন তড়িঘড়ি বেরিয়ে এসে দেখেন ঘরের বাইরে ৩ জন যুবক রিভলভার ও ভোজালি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুষ্কৃতীদের এক জন এক ক্লাব সদস্যকে হাতের নাগালে পেয়ে গলায় ভোজালি ঠেকিয়ে তাঁকে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরে। ধারালো অস্ত্র গলায় বসে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। তা দেখে অন্যেরা চিৎকার করলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ক্লাবের বাকি সদস্যেরাও। দুষ্কৃতীরা তখন ওই যুবককে ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। নিচে তখন আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষায় আরও ৬-৭ জন দুষ্কৃতী। এর পরে সদস্যেরা যখন নিচে নামার চেষ্টা করেন, তখন নিচ থেকে পর পর গুলি চালাতে থাকে দুষ্কৃতীরা। চেঁচামেচি ও গুলির শব্দে ততক্ষণে জেগে উঠেছে গোটা পাড়া। অনেকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন দেখে সদস্যদের ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিয়ে মোটরবাইকে চেপে পালায় দুষ্কৃতীরা।
কোনও হিন্দি সিনেমার শ্যুটিং নয়, সোমবার রাতের এই ঘটনাটি ঘটেছে হাওড়ার জগাছা থানা এলাকার উনসানির ষষ্ঠীতলায়। একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাত সাড়ে ১১টার সময়ে এই ঘটনা ফের প্রমাণ করে দিয়েছে হাওড়া শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঠিক কী অবস্থা। পুলিশের ভূমিকায় ক্ষিপ্ত বাসিন্দাদের অভিযোগ, এত বড় ঘটনা ঘটে গেলেও পুলিশে আসে ঘটনার প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে। শুধু তাই নয়, ঘটনার পরে ২৪ ঘণ্টা কেটে
গেলেও একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
কী ঘটেছিল ওই রাতে?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, ক্লাবের দোতলায় খেলা দেখছিলেন স্থানীয় সেভেন বুলেট্স ক্লাবের সদস্যেরা। অভিযোগ, ওই সময়ে ৭-৮ জন দুষ্কৃতীকে নিয়ে সেখানে হামলা চালায় ওই ক্লাবের প্রাক্তন সদস্য শেখ হায়দার আলি ও সাহাবুদ্দিন মোল্লা ওরফে লাল। প্রথমে দুষ্কৃতীর দল দোতলায় উঠে যে ঘরে সদস্যেরা ছিলেন, তার দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করে। সদস্যদের কয়েকজন বেরিয়ে এলে বসির আলি নামে এক সদস্যের গলায় ভোজালি চেপে ধরে এক দুষ্কৃতী। গুলিও চালায়। চিৎকার-চেঁচামেচিতে বাকি সদস্যেরাও ছুটে এলে বসিরকে ছেড়ে পালায় দুষ্কৃতীরা। নিচে নেমে রাস্তা থেকে ক্লাবের সদস্যদের তাক করে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে তারা। প্রায় আট রাউন্ড গুলি চলে বলে জানায় পুলিশ। তবে কারও গায়ে গুলি লাগেনি। ভোজালির চাপে গলায় কেটে গিয়েছিল বসিরের। হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে। রাতেই শেখ হায়দার আলি ও সাহাবুদ্দিনের নামে জগাছা থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ক্লাবের সদস্যেরা।
মঙ্গলবার সকালে গিয়ে দেখা যায় গোটা এলাকা থমথমে। মোড়ে মোড়ে বাসিন্দাদের জটলা। যে ক্লাবে এই ঘটনা ঘটেছে সেখানে দেওয়ালের কয়েক জায়গায় গুলির দাগ স্পষ্ট। ক্লাবের সদস্য শেখ শরিফ বলেন, ‘‘ওরা যে ভাবে গুলি চালাচ্ছিল আমাদের কারও লাগতেও পারত। খুব জোরে বেঁচে গেছি। তবে যে ঘটনা ঘটেছে, মনে হচ্ছে আমাদের কোনও প্রশাসন নেই। থাকলে দুষ্কৃতীরা এই সাহস পেত না।’’
পুলিশ জানায়, যে দু’জনের নামে সশস্ত্র হামলার অভিযোগ উঠেছে তারা এক বছর আগেও ক্লাবের সদস্য ছিল। কিন্তু এলাকার একটি ২৬ কাঠা জমি দখল নিয়ে ক্লাবের সঙ্গে তাদের মতান্তর হয়। ওই সময়ে তাদের সদস্যপদ বাতিল করে দেওয়া হয়। আর তখন থেকেই ওই ক্লাবের সঙ্গে তাদের শত্রুতা শুরু হয়। ওই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শেখ নজরুল বলেন, ‘‘ওরা গত বছর এলাকার এক ব্যাক্তির জমি দখল করতে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের নিয়ে পাড়ায় গোলমাল পাকিয়েছিল। এর পরেই আমরা ওদের ক্লাব থেকে তাড়িয়ে দিই। সেই থেকে ক্লাবের সঙ্গে ওদের ঠান্ডা লড়াই চলছিল। এ দিন বদলা নিতে আমাদের উপরে হামলা চালায়।’’
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, শেখ হায়দার ও সাহাবুদ্দিন এলাকার পরিচিত দুষ্কৃতী। বছর তিনেক আগে বাড়িতে অনেক আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা-সহ গ্রেফতারও করা হয় তাদের। জেলও হয় তার। জেল
থেকে ফিরে তারা ফের দুষ্কৃতীমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ায় পাড়ার ওই ক্লাবের সঙ্গে গোলমাল হয়। পুলিশের দাবি, মূলত ভয় দেখাতেই ওই রাতে হামলা চালানো হয়। ঘটনার পরেই পলাতক দুই অভিযুক্তের খোঁজ চলছে।