শোকার্ত: কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মুক্তার শেখের স্ত্রী। সান্ত্বনা দিচ্ছে ছেলে। নিহত মুক্তার (ইনসেটে) ছবি: মোহন দাস
আতঙ্কে থম মেরে রয়েছে মজফ্ফরপুর। পাশের গ্রাম মধুরপুর কার্যত সুনসান।
রবিবার রাতে খুন হয়েছেন আরামবাগের মজফ্ফরপুর গ্রামের বাসিন্দা, তৃণমূল নেতা মুক্তার শেখ। তাঁর দেহ মিলেছিল মধুরপুরের একটি টেলিফোন টাওয়ারের সামনে থেকে। হরিণখোলা-১ পঞ্চায়েত এলাকার ওই দুই গ্রামের কেউই সোমবার এ নিয়ে কথা বলতে চাইলেন না। গ্রামে পুলিশ টহল দিলেও এতটাই আতঙ্ক!
মুক্তারের স্ত্রী সাইনারা খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল আজিজ খান ওরফে লাল্টু-সহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে। দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নাম প্রকাশ না-করার শর্তে দু’এক জন গ্রামবাসী শুধু জানান, লাল্টু এবং ওর সঙ্গী নুরুল হুদার বিরুদ্ধে হরিণখোলা-১ ও ২ পঞ্চায়েত এলাকায় কথা বলার সাহস নেই। তৃণমূলের ব্লক নেতারাই দু’টি অঞ্চল পুরো ওদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। ওই গ্রামবাসীদের অভিযোগ, লুটেপুটে খেতে রাস্তার গাছ আছে, অন্যের ব্যবসা আছে, সমবায় আছে, সর্বোপরি সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা আছে। মুক্তার ও সব রুখতে সংগঠন মজবুত করছিল। তাই মরতে হল।
মুক্তার আরামবাগ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কৃষি-সেচ ও সমবায় স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ। পুরশুড়ার প্রাক্তন বিধায়ক পারভেজ রহমানের অনুগামী ছিলেন। লাল্টু আবার বর্তমান বিধায়ক মহম্মদ নুরউজ্জামানের অনুগামী বলে পরিচিত। এলাকা দখল নিয়ে দুই গোষ্ঠীর বিবাদ দীর্ঘদিনের। হরিণখোলার এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলাতে গত বছর ২২ মে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম দায়িত্ব ভাগ করে দেন পারভেজ এবং নুরুজ্জামানকে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে দলের রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশে ঘরছাড়াদের ফেরানো হলেও অশান্তি বন্ধ হয়নি হরিণখোলার দু’টি অঞ্চলে।
সেই অশান্তি এ বার প্রাণ কাড়ল এক নেতার, এমনই মনে করছেন স্থানীয়েরা। কী হয়েছিল শুক্রবার?
সাইনারার দাবি, স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনিও বেরিয়েছিলেন। তিনি দেখেন, একটু এগোতেই কয়েকজন মুক্তারকে টেনে নিয়ে যায় গ্রামের মূল রাস্তায়। সেখানে মোটরবাইকে আরও জনা কুড়ি দলীয় কর্মী ছিল। মুক্তারকে তারা মারতে মারতে মধুরপুর বাজারের দিকে নিয়ে যায়। সাইনারা বলেন, “বিপদ আঁচ করে ওখানে গিয়ে স্বামীকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করি। কেউ কথা শোনেনি। ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মধুরপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে রাস্তায় ফেলে লাঠি, রড, বাঁশ দিয়ে স্বামীকে মারধর করে। কেউ সাহায্যে এগিয়ে এলেন না।’’ এরপরে গ্রামে ফিরে তিনি পাড়া-পড়শিকে ডাকেন। ঘটনাস্থলে ফিরে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, পুলিশ স্বামীর দেহ নিয়ে চলে গিয়েছে।
মুক্তারের মেয়ে নাফিসা খাতুন আগামী বছর মাধ্যমিক দেবে। ছেলে শেখ সাইফুল হোসেন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সোমবার তার পরীক্ষা ছিল। কিন্তু বাবা খুন হওয়ায় এ দিন আর স্কুলে যেতে পারেনি। সাইনারা বলেন, ‘‘ছেলে পরীক্ষা দিতে পারল না। কোনও নোংরা কাজেই মুক্তার জড়িত ছিল না। ওর একটাই বদরোগ ছিল। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। তাতেই খুন হল।’’ প্রায় একই দাবি করেছেন মুক্তারের সহকর্মী, আরামবাগ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি শিশির সরকার। তিনি বলেন, “মুক্তারকে কেউ পিটিয়ে মারবে, ভাবতে পারিনি। মুক্তার ভাল সংগঠক ছিলেন। প্রতিবাদী ছিলেন।”
গ্রামবাসীরা চান, তৃণমূলের অন্দরের এই হানাহানি বন্ধ হোক। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে মুখ খুলতে চাননি পারভেজ। তিনি শুধু বলেন, ‘‘মুক্তারকে কেন খুন হতে হল, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব বলবেন। আমি শুধু বলতে পারি, এখনই কোনও ব্যবস্থা না-নিলে আরও অঘটন ঘটবে।’’ পুরশুড়ার বিধায়ক বলেন, “কী পরিপ্রেক্ষিতে ওই ঘটনা, জানি না।” তবে, দল গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি তপন দাশগুপ্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy