Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
থানায় ফের হানাদারি

তাণ্ডবে অসহায় পুলিশ, কাঠগড়ায় তৃণমূল

বদলাচ্ছে শুধু এলাকা। কাজ করতে নেমে রাজ্যের শাসক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে! এর আগে বোলপুরে থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোর পরেও শাস্তি হয়নি তৃণমূল নেতা সুদীপ্ত ঘোষের। রবিবার ফের সেই ঘটনাই দেখল হুগলির চাঁপদানি। যে তৃণমূল নেতার নামে মূলত অভিযোগের আঙুল, সেই তৃণমূল কাউন্সিলর তথা প্রার্থী বিক্রম গুপ্ত বহাল তবিয়তেই বাইরে রয়েছেন। এফআইআরে মূল অভিযক্ত হলেও পুলিশ এখনও তাঁকে ধরতে পারেনি। দল বলছে, ঘটনার সময় এলাকাতেই ছিলেন না তিনি।

তাণ্ডবের চিহ্ন। রবিবার দুপুরে চাঁপদানি ফাঁড়ি। ছবি: তাপস ঘোষ।

তাণ্ডবের চিহ্ন। রবিবার দুপুরে চাঁপদানি ফাঁড়ি। ছবি: তাপস ঘোষ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫৩
Share: Save:

বদলাচ্ছে শুধু এলাকা। কাজ করতে নেমে রাজ্যের শাসক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে!

এর আগে বোলপুরে থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোর পরেও শাস্তি হয়নি তৃণমূল নেতা সুদীপ্ত ঘোষের। রবিবার ফের সেই ঘটনাই দেখল হুগলির চাঁপদানি। যে তৃণমূল নেতার নামে মূলত অভিযোগের আঙুল, সেই তৃণমূল কাউন্সিলর তথা প্রার্থী বিক্রম গুপ্ত বহাল তবিয়তেই বাইরে রয়েছেন। এফআইআরে মূল অভিযক্ত হলেও পুলিশ এখনও তাঁকে ধরতে পারেনি। দল বলছে, ঘটনার সময় এলাকাতেই ছিলেন না তিনি।

বোলপুর-আলিপুর-নোয়াপাড়া-ইসলামপুর-পাত্রসায়রের পরে এ বার হামলা হুগলির চাঁপদানি ফাঁড়ি। রবিবার ভরদুপুরে সদলবল সেখানে ঢুকে ফাঁড়ির ইনচার্জ-সহ পুলিশকর্মীদের মারধর, ভাঙচুর, জিনিসপত্র তছনছ— কিছুই বাদ রাখল না হামলাকারীরা। গোটা ঘটনায় অভিযোগের তির চাঁপদানি পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থী বিক্রম গুপ্তের দিকে। তাঁর নেতৃত্বেই এ দিন তৃণমূলের লোকজন তাণ্ডব চালায় বলে পুলিশের অভিযোগ। তবে এ নিয়ে নামকেওয়াস্তে মামলা দায়ের ও ৯ জনকে গ্রেফতার করা হলেও হামলাকারীদের পাণ্ডা কিন্তু অধরাই রয়েছেন দিনের শেষে।

সেই বিক্রম গুপ্ত। — নিজস্ব চিত্র।

পুরভোটের মুখে এমন ঘটনায় দলের নেতা-কর্মীরা জড়িয়ে যাওয়ায় তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব অস্বস্তিতে পড়লেও তাঁরা কিন্তু প্রথম থেকেই দলের নেতাকে বাঁচাতে মাঠে নেমেছেন বলে অভিযোগ। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, প্রাথমিক ভাবে তিনি জানতে পেরেছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা হচ্ছে, তাঁরা ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। পার্থবাবু ও দলের জেলা নেতৃত্ব দায় চাপাচ্ছেন তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবে দাঁড়ানো এক প্রার্থীর ঘাড়ে।

পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্য রকম। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকাল থেকেই চাঁপদানি ফাঁড়ির পুলিশ জি টি রোডে মোটরবাইক ‘চেকিং’ করছিল। বেলা ১২টা নাগাদ এক যুবক মোটরবাইকের কাগজপত্র দেখাতে না পারায় তাঁকে ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বিক্রমবাবুকে ফোন করেন। বিক্রমবাবু দলবল নিয়ে ফাঁড়িতে যান। অভিযোগ, ফাঁড়ির ইনচার্জ জয়ন্ত পালের কাছে তিনি কৈফিয়ত চান, কেন ওই যুবককে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আরও অভিযোগ, এর পরেই জয়ন্তবাবুর উর্দির কলার ধরে তাঁকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন বিক্রমবাবু। ফাঁড়িতে তখন জনা দশেক পুলিশকর্মী ছিলেন। তাঁরা বাধা দিতে গেলে বিক্রমবাবুর সঙ্গে আসা লোকজন তাঁদের উপরে চড়াও হয়। বিক্রমবাবু ফোনে আরও লোকজনকে খবর দেন বলে অভিযোগ। কিছু ক্ষণের মধ্যেই কয়েক হাজার লোক ফাঁড়ি ঘিরে ফেলে। তত ক্ষণে ভদ্রেশ্বর থানার (ফাঁড়িটি ওই থানার অধীনেই) ওসি অনুদ্যুতি মজুমদার সেখানে চলে এসেছেন বাহিনী নিয়ে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা সংখ্যায় প্রচুর থাকায় তাঁরা সে ভাবে প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হন। হামলাকারীরা ফাঁড়ির চত্বরে থাকা অন্তত ১৫টি মোটরবাইক ভাঙচুর করে। পুলিশের একটি গাড়ি উল্টে দেয়। ভিতরে ঢুকে আসবাবপত্র, জানলার কাচ ভাঙে ও পুলিশকর্মীদের মারধর করা হয় বলে অভযোগ। পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে তৃণমূলের লোকজনের ইটের আঘাতে জখম হন ভদ্রেশ্বর থানার ওসি অনুদ্যুতিবাবু। কিছু সময়ের মধ্যে ফাঁড়িতে হামলার কথা জেলার অন্যান্য থানায় পৌঁছে যায়। এর পরে চারটি থানা থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী আসে। তত ক্ষণে হামলাকারীরা পালিয়ে গিয়েছে।

এই তাণ্ডব সামাল দিতে সব মিলিয়ে ৯ জন পুলিশকর্মী জখম হয়েছেন। বাঁশের আঘাতে উত্তম সোম নামে ভদ্রেশ্বর থানায় এক পুলিশকর্মীর বাঁ চোখের উপরে গুরুতর চোট লাগে। তাঁকে চন্দননগর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

ফাঁড়িতে হামলার পরে তৃণমূলের নেতৃত্বে প্রায় আধ ঘণ্টা জি টি রোড অবরোধ করা হয়। বিক্রমবাবুকে পুলিশ মারধর করেছে বলে অভিযোগ তোলেন অবরোধকারীরা। পুলিশ সেই অভিযোগ মানেনি। লাঠি চালিয়ে, শূন্যে চার রাউন্ড গুলি এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে পুলিশ অবরোধকারীদের হটিয়ে দেয়। পরে চারটি থানা থেকে আসা বিশাল পুলিশ বাহিনী ওই পুর এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে তল্লাশি চালিয়ে ৯ জনকে গ্রেফতার করে। তবে মূল অভিযুক্ত কেন এখনও বীর বিক্রমে বাইরে? জেলার পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী শুধু বলেন, ‘‘ফাঁড়িতে হামলার ঘটনায় নির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। বাকি অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।’’

আর কী বলছে বিক্রম গুপ্তের দল?

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক মুজফ‌্ফর খান এবং দলের হুগলি জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্তর কাছ থেকে চাঁপদানির ঘটনার রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশকে বলা হয়েছে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তবে পার্থবাবুর বক্তব্য, ‘‘প্রাথমিক রিপোর্ট যা পেয়েছি, তাতে মনে হচ্ছে, তৃণমূলের যাঁদের নামে অভিযোগ করা হচ্ছে, তাঁরা কেউ ঘটনাস্থলে ছিলেন না। এক নির্দল প্রার্থী কিছু গোলমাল করেছেন বলে শুনেছি। তাঁর সঙ্গে এখন তৃণমূলের সম্পর্ক নেই। তবুও ঘটনাটিকে লঘু করে দেখতে চাই না বলেই বিশদ রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে।’’

অভিযুক্ত হিসেবে পুলিশ বিক্রমবাবুর নামে মামলা রুজু করলেও তিনি গোলমালে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন দলের জেলা সভাপতি তপনবাবুও। তিনি বলেন, ‘‘বিক্রমবাবু নন, দলের টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবে ওই ওয়ার্ডে দাঁড়িয়ে পড়া জিতেন্দ্রপ্রসাদ সিংহ-সহ আমাদের ৬ জন নেতা-কর্মী গোলমালে জড়িত ছিলেন বলে দলীয় তদন্তে জানা গিয়েছে। ওই ৬ জনকে পাঁচ বছরের জন্য দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।’’ অনেক চেষ্টা করেও বিক্রমের সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন

সাম্প্রতিক কালে একের পর এক ঘটনায় পুলিশের উপরে হামলায় নাম জড়িয়েছে শাসক দলের। কয়েক মাস আগে লেক টাউন মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে চড় মারার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। বিরোধীদের অভিযোগ, ক্ষমতায় আসার পরেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে রাতে ভবানীপুর থানায় হাজির হয়ে একটি ঘটনায় ধৃতদের ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার পর থেকেই সাহস বেড়ে গিয়েছে তৃণমূলের নেতা-ক়র্মীদের। পুলিশের উপরে লাগাতার হামলা হচ্ছে।

গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের ভূমিকাও সমালোচনার মুখে পড়েছে বারবার। শাসক দলের সঙ্গে পুলিশের ‘আঁতাঁত’ নিয়েও সরব হয়েছেন বিরোধীরা। কিন্তু নিচু তলার পুলিশকর্মীদের ক্ষোভ, নিজেদের ‘ডিউটি’ করতে গিয়েও যে ভাবে বারবার তাঁদের হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে, তাতে মনোবল আরও তলানিতে পৌঁছচ্ছে। বিশেষ করে, শাসক দলের কোন নেতা-কর্মী বা তাঁদের ঘনিষ্ঠ কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে পুলিশকে রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে। বীরভূমে রাজনৈতিক সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের বোমার ঘায়ে মারা গিয়েছেন দুবরাজপুর থানার টাউনবাবু অমিত চক্রবর্তী। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের এক জনকেও ধরতে পারেনি পুলিশ। একই ভাবে বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোর ঘটনায় মূল অভিযুক্ত যুব তৃণমূল নেতা সুদীপ্ত ঘোষও পার পেয়ে গিয়েছেন। দু-দু’বার তাঁর জামিনের আর্জি খারিজ হয়েছে। অথচ পুলিশ তাঁকে ধরার সাহস দেখাতে পারেনি। সম্প্রতি পুলিশ চার্জশিট দেওয়ার পরে তিনি আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। বদলি হয়েছেন প্রহৃত পুলিশকর্মীই!

এ দিনের ঘটায় স্তম্ভিত রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশকর্তারা। রাজ্যের প্রাক্তন ডিজি অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ক্ষমতায় এলে মাথার ঠিক থাকে না। এর জন্য এরা ক্রমাগত আশকারা পাচ্ছে। এ সব বন্ধ হওয়া উচিত।’’ কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার বলেন, ‘‘পুলিশ শাসককে ছেড়ে বিরোধীদের ধরুক— এটা আগেও ছিল। কিন্তু এখন সেটা তীক্ষ্ণ ভাবে ফুটে উঠছে। এমনটা ঘটতে থাকলে পুলিশকে কেউ আর সমীহ করবে না।’’ আর এক প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার সুজয় চক্রবর্তী মনে করেন, ‘‘বার বার পুলিশের উপরে আক্রমণ করেও কোনও ব্যবস্থা না হওয়ায় এমনটা হচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।’’

বিরোধীরাও দাবি করছেন, চাঁপদানি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজ্যের সর্বত্রই শাসক দলের হাতে সাধারণ নাগরিক থেকে পুলিশ পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘পুলিশমন্ত্রীর নির্দেশে তৃণমূলের গুন্ডাদের কাছে মাথা নত করতে করতে পুলিশ নিজেদেরই বিপদ ডেকে এনেছে। এখন তৃণমূলের বাহিনী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে পুলিশকে মারছে! বামপন্থী ছাত্রদের উপর যে পুলিশ বীরত্ব দেখিয়ে লাঠি চালায়, শাসক দলের কাছে তাদেরই অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়!’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘তৃণমূলের সন্ত্রাসে ওখানে আমরা প্রার্থী দিতে পারিনি। পুলিশও যে আক্রান্ত হবে, এতে আর আশ্চর্য কী!’’

চাঁপদানির প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক আব্দুল মান্নানের বক্তব্য, ‘‘গত কয়েক বছরে বহু মানুষ যখন তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন, পুলিশ তখন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং, অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে। এখন পুলিশের উপরেই আক্রমণ ব্যুমেরাং হয়ে আসছে!’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার! পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঘোষ যে বার্তা দিয়েছেন, তার পরে তৃণমূল কর্মীদের কাছে এই আচরণই প্রত্যাশিত। পুলিশ তো দীর্ঘদিন ধরেই শাসক দলের শাখা সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সে জন্যই তৃণমূল তাদের সবক শিখিয়েছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE