Advertisement
E-Paper

ঐতিহ্য খুইয়ে আজ শিল্পে মলিন এ শহর

রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে চলতি সময়ে চায়ের কাপে তুফান উঠছে। গেল গেল রব সর্বত্র। কিন্তু একটু পিছনে হাঁটলে ছবিটা একেবারেই উল্টো। দেখা গিয়েছে রাজ্যের প্রতি বিমুখতা নয়। শিল্প আর সম্পদের টানে বিদেশি ঔপনিবেশিকেরা বাসা বেঁধেছেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এই পশ্চিমবঙ্গে। তারপর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাঁদের নিজেদের মধ্যেই বেধেছে যুদ্ধ।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০৯
একদা ডেনিস গভর্নরের অফিস বর্তমানে মহকুমাশাসকের বাংলো।

একদা ডেনিস গভর্নরের অফিস বর্তমানে মহকুমাশাসকের বাংলো।

রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে চলতি সময়ে চায়ের কাপে তুফান উঠছে।

গেল গেল রব সর্বত্র। কিন্তু একটু পিছনে হাঁটলে ছবিটা একেবারেই উল্টো। দেখা গিয়েছে রাজ্যের প্রতি বিমুখতা নয়। শিল্প আর সম্পদের টানে বিদেশি ঔপনিবেশিকেরা বাসা বেঁধেছেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এই পশ্চিমবঙ্গে। তারপর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাঁদের নিজেদের মধ্যেই বেধেছে যুদ্ধ।

এখনকার মতো সেই সময়ে সম্ভবত পরিকাঠামো নিয়ে এত ঘ্যানঘ্যানানি ছিল না। পরিকাঠামো ছাড়া শিল্পের ভাঁড়ার শূন্য, এমনটাই দস্তুর। বলা হচ্ছে এই সময়ে। ভাবলে বিস্ময়ে ঘোর লাগে। এক সময় পরিকাঠামো বলতে ছিল শুধু ধূ-ধূ ফাঁকা মাঠ আর বিচ্ছিন্ন কিছু জনপদ।

কিন্তু স্রেফ জলসম্পদ আর মানব সম্পদকে কাজে লাগিয়েছিলেন বিদেশিরা। হুগলিতে অধুনা প্রায় লুপ্ত সরস্বতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল সপ্তগ্রাম বন্দর। পরিকাঠামো ঢেলে সাজিয়ে ঔপনেবেশিকেরা শিল্পের বাগানে ফুল ফুটিয়েছিলেন। কাজে লাগিয়ে ছিলেন ভূমিজ শিল্প আর শিল্পীদের।

বর্তমানে শ্রীরামপুরে মহকুমাশাসকের গঙ্গাতীরের বাসভবনটি ছিল ডেনিস শাসনকালে গর্ভনরের আবাসস্থল। সালটা ১৭৫৫। তখন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ। তাঁর কাছ থেকে ডেনিসরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কুঠি তৈরি ও বাণিজ্যের অনুমতি লাভ করে। ওই বছরই ডেনিস ব্যবসায়ীরা শ্রীরামপুরে পা রাখেন। ৮ অক্টোবর ৬০ বিঘে জমি অধিগ্রহণ করে গঙ্গাতীরে বাণিজ্য কুঠি তৈরি করে ডেনিসরা। ১৭৭৮ সালে শ্রীরামপুর সরাসরি ডেনমার্কের রাজার শাসনে চলে যায়। ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ডেনিস গভর্নর আসেন শ্রীরামপুর পরিচালনার দায়িত্বে। ওই বছর অবশ্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী গঙ্গপারের এই ঐতিহাসিক শহর।

ডেনিস শাসকেরা মাত্র সাড়ে ১২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে উপনিবেশটি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়। বদলে যায় শাসক। এই সময়ের ঐতিহাসিকেরা ভেবে শুধু আকুল হন না, হন বিস্মিতও। এই ভেবে যে কার দেশ? অধিকারই বা কাদের? আর কারা বেমালুম তা হস্তান্তর করছেন? এই সব দেখেই হয়তো বা কৌতুকে অন্নদাশঙ্কর লিখেছিলেন:

চোরের প্রিয় আঁধার ঘর/

ফরাসিদের চন্দননগর

শিশুর প্রিয় চানাচুর/

দিনেমারদের শ্রীরামপুর

১৯৫৪ সালে ফরাসি অধিকৃত চন্দননগর হুগলি জেলার মধ্যে চলে আসে। শ্রীরামপুরকে একটি আলাদা মহকুমা তৈরি করা হয়। শ্রীরামপুর এক সময় শেওড়াফুলির রাজা মনোহর চন্দ্র রায়ের অধীনে ছিল। তিনি সেখানে শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপরে নামকরণ করেন শ্রীরামপুর। শেওড়াফুলির জমিদারির অংশ হিসেবে শ্রীরামপুরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি গ্রাম। মাহেশে জগন্নাথের মন্দির, চাতরায় গৌরাঙ্গদেবের মন্দির আর বৈদ্যবাটির নিমাইতীর্থ ঘাট--এ সবই ছিল তখনকার দিনে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান।

তবে শ্রীরামপুরে মুসলমান শাসনকালে সব সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে সহাবস্থান লক্ষ্যণীয়। চাষি, তাঁতি, কামার, কুমোর, জেলে, নাপিত নিয়ে নানা পেশার মানুষদের বাস ছিল। সরস্বতী নদীর দু’ধারে তখন সমৃদ্ধি আর বাণিজ্যের মেলবন্ধন। রেশম, তাঁত, মসলিন, দড়ি ছাড়াও ছিল আরও নানা হস্তশিল্প। আদি সপ্তগ্রাম বন্দর থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে রফতানি বাণিজ্য চলত। চণ্ডীতলা, জনাই, বেগমপুর, শিয়াখালা, রাজবলহাটের বাণিজ্যসম্ভার সপ্তডিঙি বেয়ে চলে যেত দেশ-দেশাম্তরে। শিল্প আর সভ্যতার অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটে সেই সময়। মঙ্গলকাব্যের পটভূমি, চাঁদসওদাগর কাহিনী--এই অঞ্চলের বৈভবের নানা কাহিনী চিত্রিত আছে।

ক্রমে সরস্বতী নদী মজে গঙ্গা যখন স্রোতস্বিনী হল তখন ডাচ, ফরাসি, ডেনিস, ইংরেজ বণিকের দল গঙ্গার ধারে উপনিবেশ তৈরি করে। তার হাত ধরেই রাতারাতি যেন শহুরে সভ্যতার ঝলক এসে পড়ল এই সমস্ত জায়গায়। বণিকদের হাত ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তের বাণিজ্য সম্ভার এল শ্রীরামপুরে। এল আধুনিকতা। বিদেশি পর্যটক আর যাত্রীদের জন্য তৈরি হল হোটেল। শ্রমজীবী মানুষদের আয় বাড়ল। শ্রীরামপুর আস্তে আস্তে জলা জায়গা থেকে শহরে উন্নীত হল। বৈদাবাটির কুমড়ো পাড়ি দিল সাগর। শিল্পায়নের মাধ্যমে একটা জায়গা ক্রমেই সার্বিকভাবে উন্নত হল।

ইতিহাসের সেই উজ্বল ছবি কিন্তু বর্তমানে একেবারেই ফিকে। বিবর্ণ আর মলিন। গঙ্গাপারে ইংরেজ আমলে তৈরি চটকলগুলির বেশিরভাগই এখন ধঁুকছে। শ্রমিকদের চাওয়া-পাওয়ার গরমিলে নিত্যনতুন অশান্তি এখন জুটমিলগুলিতে প্রতিদিনের ঘটনা। এক সময় শ্রীরামপুরে ইন্ডিয়া জুটমিল, ওয়েলিংটন জুটমিল, হেস্টিংস জুটমিল রমরমিয়ে চলত। কিন্তু এখন ইন্ডিয়া জুট ও হেস্টিংস জুটমিলে অশান্তির কালো ছায়া। শুধু জুটমিল নয়, এক সময় শ্রীরামপুরে শাড়ি তৈরির নানা মিল রমরম করে চলত। রামপুরিয়া, বঙ্গলক্ষী আর লক্ষীনারয়ণ কটন মিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এখন এই শহরে শাড়ি তৈরির বড় মিলগুলির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

শ্রীরামপুরের বিশিষ্ট চিকিত্‌সক সৌরভ সান্যাল বলেন, “জুটমিলগুলি ইংরেজ আমলের। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল রেখে এবং বাজারের চাহিদাকে মাথায় রেখে সেগুলির পরিকাঠামোগত কোনও পরিবর্তন হয়নি। এখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতিও বদলেছে। ফলে সার্বিকভাবেই একটা মন্দার ছায়া।”

ভারতের মধ্যে শ্রীরামপুরেই ছিল প্রথম পেনিসিলিন ওষুধ তৈরির কারখানা স্ট্যান্ডার্ড ফামাটিক্যালস্‌। কিন্তু সেই কারখান উঠে গিয়েছে কবেই। শ্রীরামপুরে জে কে স্টিল ছিল রাজ্যের প্রথমদিকের লোহা কারখানাগুলির অন্যতম। কিন্তু সেই কারখানা অস্তিত্ব হারিয়ে এখন ফাঁকা মাঠ। শ্রীরামপুরেই ছিল প্রথম ডালডা তৈরির বড় কারখানা কুসুম। সেই কারখানাও হারিয়ে গিয়েছে। একমাত্র বিড়লা গোষ্ঠীর জয়শ্রী কারখানাই ডানা মেলেছে উন্নতির উড়ানে।

শিল্পের নিরিখে অতীতের সঙ্গে বর্তমানে শ্রীরামপুর যেন এখন অনেকটাই তার উজ্বলতা খুইয়ে মলিন।

(চলবে)

ছবি: দীপঙ্কর দে, তাপস ঘোষ ও প্রকাশ পাল।

sreerampore gautam bandopadhay southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy