এক সময় গ্যাসের বাতি জ্বলত এই তল্লাটে। গঙ্গার পাড়ে বসত মেলা। বড়লাটদের উপস্থিতিতে শীতের রোদে গা সেঁকে চলত ক্রীড়া উৎসব। ইতিহাস বলছে, কলকাতার পরে গঙ্গাপাড়ের এই শহরেই প্রথম বাতিস্তম্ভের আলো জ্বলেছিল। ফুটপাতের ভাবনাও ছিল কলকাতার পরে এখানেই প্রথম। বস্তুত চন্দননগরের স্ট্র্যান্ডঘাটকে মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন ফরাসিরা। তাঁদের আশঙ্কা ছিল গঙ্গার পাড় কোনওভাবে ভাঙতে পারে। সেই আশঙ্কা দূর করতে গঙ্গায় বাঁধ দেওয়া হয়েছিল তখন। তৈরি হয়েছিল গঙ্গার উপর জেটি। গঙ্গার পারের কাছেই ছিল সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সব অফিস। গভর্নর হাউস। সেই আমলেই সেজে উঠেছিল চন্দননগরের স্ট্র্যান্ডঘাট।
সেই ইতিহাসের পাতা থেকে এখনকার শাসক, বস্তুত সব আমলেই চন্দননগরের গঙ্গার পাড়কে সাজিয়ে তোলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও হাল আমলের সরকারি পরিকল্পনা নিয়ে ইতিমধ্যেই কিছু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ইতিহাস সচেতন চন্দননগরবাসীদের মনে। কারণ ইতিউতি শোনা যাচ্ছে, এখন চন্দননগর স্ট্র্যান্ডঘাটে যে পাথরের উপর দিয়ে হাঁটা হয় সেগুলি নাকি সরিয়ে ফেলা হবে। পরিবেশবিদ এবং চন্দননগরের বাসিন্দা বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ওই পাথরগুলো প্রায় ১০০ বছরের পুরনো। অতীতের গন্ধমাখা রয়েছে। তাই সেগুলি যতটা সম্ভব অক্ষত রেখে মেজেঘষে পরিষ্কার করলেই বোধহয় ভাল। যাঁরা পরিকল্পনা করছেন তাঁরা নিশ্চয় অতীতকে রক্ষা করেই সবকিছু করবেন। এমনটাই আমার বিশ্বাস।”
একদা এই ফরাসি উপনিবেশ শহরের গঙ্গার পাড়কে আরও বেশি নয়নাভিরাম করে তুলতে কোটি টাকা ব্যয় করছে রাজ্যের পর্যটন দফতর। গত ১৮ জুন সেই কাজের টেন্ডারও হয়ে গিয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, স্ট্র্যান্ডের আমূল সংস্কার করা হবে। রাস্তায় আধুনিক টাইলস বসানো হবে। যে সমস্ত জায়গা জীর্ণ হয়েছে বা ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে, সেগুলির আমূল সংস্কার করা হবে। গঙ্গার পাড় বাঁধানো হবে কলকাতার মিলেনিয়াম পার্কের ধাঁচে। ওই চত্বরে বেশ কিছু ঝুপড়ি এবং অস্থায়ী দোকানপাট রয়েছে। সেই সব ঝুপড়ি-দোকানদারদের অন্য জায়গায় পুনর্বাসন দেওয়া হবে। গোটা স্ট্র্যান্ড জুড়ে পর্যাপ্ত সংখ্যায় অত্যাধুনিক আলো বসানো হবে। গোটা চত্বর মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের রং নীল-সাদায় রাঙিয়ে দেওয়া হবে।
রাজ্য পর্যটন দফতর সূত্রের খবর, পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের প্রয়োজনে বরাদ্দের অতিরিক্ত বাড়তি টাকা লাগলে, তা-ও দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে এখানে বাটারফ্লাই পার্ক তৈরির চিন্তা-ভাবনাও রয়েছে।
হুগলির অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) আবিদ হোসেন জানান, ঐতিহাসিক এই জায়গাকে ঢেলে সাজার জন্য ১ কোটি ১৯ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে পর্যটন দফতর। তিনি বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই ৩৫ লক্ষ টাকা এসে গিয়েছে। কাজের টেন্ডারও হয়ে গিয়েছে। চলতি মাসেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।’’
সারা বছরই চন্দননগরে গঙ্গার ধারের এই জায়গাটি জমজমাট থাকে। ভোরবেলা এখানে হাঁটতে বেরোন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। তা ছাড়া কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণী থেকে সাধারণ ছেলে-ছোকরারা যেমন আড্ডার জায়গা হিসেবে স্ট্র্যান্ডকে বেছে নেন, তেমনই বিকেল হলে এখানে খোলা হাওয়ায় দু’দণ্ড গল্প করার জন্য আসতে শুরু করেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা।
রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, লন্ডনের মতো গঙ্গার দুই তীরের সৌন্দর্যায়ন করতে চান তিনি। কলকাতায় মিলেনিয়াম পার্ককে ইতিমধ্যেই ঢেলে সাজিয়েছে রাজ্য সরকার। চন্দননগরকেও অনেকটাই সেই আদল দিতে চায় রাজ্য। গত দু’বছর পর পর জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্বোধনে চন্দননগরের ঘুরে যান মমতা। দু’বারই এখানে এসেছিলেন কলকাতা থেকে জলপথে। প্রথমবার মমতার সঙ্গে ছিলেন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। সে বার তিনি গঙ্গার ধারের সৌন্দর্যায়নের বিষয়ে চন্দননগরের মেয়র রাম চক্রবর্তীকে বলেছিলেন প্রকল্প পাঠাতে। গত বছর মমতার সঙ্গে এসেছিলেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। সৌন্দর্যায়নের কাজের বিষয়টির তেমন ভাবে না অগ্রগতি না হওয়ায় জেটিতে নেমেই চন্দননগর পুরসভার শীর্ষকর্তাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মঞ্চে দাঁড়িয়েই তিনি মদনবাবুকে বিষয়টি দেখাশোনা করতে বলেন।
এর পরেই নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি। স্থানীয় বিধায়ক অশোক সাউ এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পাঠান পর্যটন দফতরে। জেলা প্রশাসনের তরফেও রাজ্যে প্রকল্প রিপোর্ট জমা পড়ে। এর পরেই পর্যটন দফতরের তরফে টাকা বরাদ্দ করা হয়। স্ট্র্যান্ডের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে ঐতিহাসিক পাতাল বাড়ি। উত্তর প্রান্তে রানিঘাট। উল্টোদিকে রবীন্দ্রভবন থেকে শুরু করে, স্কুল-কলেজ সবই রয়েছে। আদালত, সংশোধনাগার রয়েছে ওই চত্বরে। অশোকবাবু বলেন, ‘‘শীঘ্রই কাজ শুরু হবে, ওই জায়গার সংস্কারের কাজ জরুরি ছিল। ওখানে বসার বেঞ্চ ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। রাস্তার অনেক টাইলসও ভেঙে গিয়েছে। সংস্কার হলে পুরো জায়গাটিই নতুন রূপ পাবে। আরও সুন্দর, আকষর্ণীয় হয়ে উঠবে স্ট্র্যান্ড।’’