Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
তারকেশ্বর

নিকাশি থেকে বেআইনি নির্মাণ, কাঠগড়ায় পুরসভা

আধুনিক শহর বলতে তার উন্নত নাগরিক পরিষেবাকেই বোঝানো হয়। অথচ পুর-শহর হলেও তারকেশ্বরে সেই নাগরিক পরিষেবার প্রাথমিক শর্তগুলি আজও পূরণ হয়নি। পানীয় জল, নিকাশি, রাস্তা, আলো এসবের সার্বিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মধ্যেই একটি শহর গড়ে ওঠে। আর আধুনিক বাস্তুকারদের মতে শহরে অবশ্যই পর্যাপ্ত সবুজ থাকবে। থাকবে ওপেন স্পেস (ফাঁকা জায়গা)। নগরায়নের চাপে প্রায় প্রতিটি শহরেই জমি ও মানুষের সমতা বিঘ্নিত হচ্ছে পদে পদে।

গৌতম বন্দোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৫৬
Share: Save:

আধুনিক শহর বলতে তার উন্নত নাগরিক পরিষেবাকেই বোঝানো হয়। অথচ পুর-শহর হলেও তারকেশ্বরে সেই নাগরিক পরিষেবার প্রাথমিক শর্তগুলি আজও পূরণ হয়নি।

পানীয় জল, নিকাশি, রাস্তা, আলো এসবের সার্বিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মধ্যেই একটি শহর গড়ে ওঠে। আর আধুনিক বাস্তুকারদের মতে শহরে অবশ্যই পর্যাপ্ত সবুজ থাকবে। থাকবে ওপেন স্পেস (ফাঁকা জায়গা)। নগরায়নের চাপে প্রায় প্রতিটি শহরেই জমি ও মানুষের সমতা বিঘ্নিত হচ্ছে পদে পদে।

স্থানীয় মানুষজনের অভিযোগ, বাম আমলে শহরের বুকে প্রোমোটারিরাজের পত্তন শুরু হয়েছিল। বর্তমান শাসকদল ক্ষমতায় আশার আগে আশ্বস্ত করেছিল, তাতে লাগাম পরানো হবে। প্রকাশ্যে বা লুকিয়ে-চুরিয়ে দলের কেউ যেন প্রোমোটারিতে মদত না দেয় তা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু পালাবদলের পরে সেই প্রতিশ্রুতিই এখন পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে। তারকেশ্বর পুরসভায় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল বামেরা। গত নির্বাচনে পুরবোর্ড দখল করে তৃণমূল। কিন্তু পুরসভার পরিবর্তনে শহরে কোনও প্রভাব ফেলেনি।

প্রোমোটারি থেকে জমি বাড়ির দালালি, শহর জুড়ে এখন রমরমা শাসকদলেরই কেষ্টবিষ্টুদের। তারকেশ্বর বাসস্ট্যান্ডে গড়ে উঠছে আকাশচুম্বি (১০ তলা) আবাসন। তার নীচের তলায় পুরসভায় অনুমতি না নিয়েই বেআইনি ভাবে গড়ে উঠেছে পর পর দোকানঘর। স্থানীয় এক প্রবীণের অভিযোগ,“শাসকদলের এক নেতার নিজস্ব ঝাঁ-চকচকে বাতানুকূল প্রোমোটারির অফিস তৈরি হয়েছে বাসস্ট্যান্ড চত্বরে। সেই অফিসে নিত্য আনাগোনা এলাকায় সুনাম নেই এমন ছেলেদের। পুলিশ সব জেনেও নিরুত্তর, কারণ ওরা যে শাসকদলের।”

অথচ রাজ্যে পালাবদলের পর কিছুটা নড়াচড়া দেখা গিয়েছিল তারকেশ্বর শহরকে ঘিরে। পর্যটন দফতরের বোর্ড পড়েছিল শহরে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বস্তুত, দেশের অন্যতম বিখ্যাত এই শৈবতীর্থকে কেন্দ্র করে না ডান না বাম কেউই এ পর্যন্ত সার্বিক পরিকল্পনা নেয়নি। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তাতে পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। এই অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যের শ্রম দফতরের পরিষদীয় সচিব তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি তপন দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, “রাজ্যের পর্যটন দফতরে তারকেশ্বরের সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে প্রকল্প জমা রয়েছে। যে কোনও দিন তা ছাড়পত্র পেয়ে যাবে।” তাঁর আরও সংযোজন, “শহরে কোনওরকম ঠিকাদারি বা প্রোমোটারির সঙ্গে আমাদের দলের কেউ যুক্ত হতে পারবে না। দলের সে দিকে কড়া নজর রয়েছে। এ বিষয়ে কোনও লিখিত অভিযোগ পেলে সরাসরি রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়ে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।”

প্রোমোটারদের দাপটে অতিষ্ঠ শহরবাসী অবশ্য এমন আশ্বাসে ভুলতে নারাজ। তাঁদের কথায়, আশ্বাস অনেক দেওয়া হয়েছে। তাই, এখন আর না আঁচালে বিশ্বাস নেই। যেমন বাম আমলে পুর কর্তৃপক্ষের আশ্বাস ছিল শহরের নিকাশির হাল ফেরানো। বলাবাহুল্য তা হয়নি। শহরের বহু পুরনো বেহাল নিকাশির কারণে বছর কয়েক আগে শহরের জমা জল মন্দির পর্যন্ত হানা দিয়েছিল।পরিস্থিতি এমন হয় যে বালির বস্তা দিয়ে কোনওক্রমে সে যাত্রায় মন্দির রক্ষা করেছিলেন মন্দির কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে শহরে এই পরিস্থিতির আদৌ পরিবর্তন হবে তো?

পুর কর্তৃপক্ষের সাফাই, শহরের অদূরে যে নিকাশি নালা রয়েছে, বাম আমল থেকেই তার সংস্কার হয়নি। ওই নালার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। সেটি অকেজো হয়ে পড়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু নিকাশি নয়, শহর পরিষ্কারের বিষয়েও পুরসভার নজর না থাকার অভিযোগ উঠেছে। পর্যাপ্ত কর্মী নেই। নেই ময়লা পরিষ্কার সংক্রান্ত পুর কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট কোনও নীতি। পুর এলাকর ১৫টি ওয়ার্ডের করদাতাদের বাড়ি বাড়ি আবর্জনা নিয়ে আসার মতো পরিকাঠামোও নেই। শহরে প্লাস্টিক এখনও নিষিদ্ধ করেনি পুর কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে পরিষেবা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই।

রাজ্যের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র দীঘার বাস এখান থেকে যাতাযাত করে। কলকাতাগামী সরকারি বাসও যায়। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের অবস্থা ভাল নয়। পর্যাপ্ত শৌচাগার নেই। নেই যাত্রী ছাউনি। ফলে বাসের অপেক্ষায় থাকতে গিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের। এলাকায় নতুন বাসস্ট্যান্ড এখন চালু করা যায়নি। ফলে পুরনো বাসস্ট্যান্ডে গাড়ির চাপ বেড়েই চলেছে। সমস্যা গুরুতর আকার নেয় শ্রাবণী মেলার সময় এবং মন্দিরে কোনও উৎসব থাকলে। এ সব ক্ষেত্রে শহরে বাড়তি লোকজন সামাল দেওয়ার কোনও পরিকাঠামোই গড়ে তোলেনি পুরসভা। নজরদারির গাফিলতিতে তারকেশ্বর স্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ড চত্বরে খোলা জায়গায় যত্রতত্র দোকানঘর তৈরি হয়েছে। ঘিঞ্জি দোকানের চাপে সংকীর্ণ রাস্তায় যে কোনও সময় দুর্ঘটনায় আশঙ্কা রয়েছে।

পুরপ্রধান স্বপন সামন্ত বলেন, “বাম আমলে পুরসভায় গঠনমূলক কোনও কাজ হয়নি। তারকেশ্বরে নিকাশির সার্বিক প্ল্যান তৈরি করে আমরা রাজ্য সরকারের কাছে পাঠিয়েছি। পুর ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রক সেটি অনুমোদনের জন্য দিল্লি পাঠিয়েছে। ২০ কোটি টাকা ব্যায়ে ওই কাজ হবে।” বেআইনি নির্মাণ নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “রাজ্যের সব পুরসভা এলাকাতেই বেআইনি নির্মাণের সমস্যা রয়েছে। অনেক সময় বেআইনি নির্মাণ করে আদালতে চলে যাচ্ছেন অনেকে। সে ক্ষেত্রে পুরকর্তৃপক্ষের কিছু করার থাকে না।”

পুরপ্রধান যে যুক্তিই দিন, শহরবাসীর বক্তব্য, শাসক দলের লোকেরাই যেখানে বেআইনি নির্মাণে সঙ্গে জড়িত, সেখানে পুরপ্রধানের কী-ই বা করার আছে।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE