Advertisement
০৮ মে ২০২৪

ভাঙনে জেরবার বলাগড়, ঘর হারাচ্ছেন গ্রামবাসী

গঙ্গা যে তাঁদের কত বার বে-ঘর করেছে তার ইয়ত্তা নেই। গঙ্গার গ্রাসে হারিয়ে গিয়েছে একটি গোটা মৌজা। বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি। নিশ্চিহ্ন হয়েছে খেলার মাঠ, ধানকল, ঠাকুরের থান... কত কিছু! হুগলির বলাগড় ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ নদী-ভাঙনের জেরে কার্যত সর্বস্বান্ত। বারে বারেই ভাঙন আটকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন। দু’এক বার বিচ্ছিন্ন ভাবে সরকারি তরফে চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু তাতে বিশেষ ফল না হওয়ায় এ বার নদীপাড় কংক্রিটের বোল্ডারে বাঁধানো এবং গাছ লাগানোর দাবি তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।

এ ভাবেই পাড় ভেঙে গ্রামের ভিতরে ঢুকে আসছে গঙ্গা।-নিজস্ব চিত্র।

এ ভাবেই পাড় ভেঙে গ্রামের ভিতরে ঢুকে আসছে গঙ্গা।-নিজস্ব চিত্র।

প্রকাশ পাল
বলাগড় শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১৪
Share: Save:

গঙ্গা যে তাঁদের কত বার বে-ঘর করেছে তার ইয়ত্তা নেই।

গঙ্গার গ্রাসে হারিয়ে গিয়েছে একটি গোটা মৌজা। বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি। নিশ্চিহ্ন হয়েছে খেলার মাঠ, ধানকল, ঠাকুরের থান... কত কিছু! হুগলির বলাগড় ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ নদী-ভাঙনের জেরে কার্যত সর্বস্বান্ত। বারে বারেই ভাঙন আটকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন। দু’এক বার বিচ্ছিন্ন ভাবে সরকারি তরফে চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু তাতে বিশেষ ফল না হওয়ায় এ বার নদীপাড় কংক্রিটের বোল্ডারে বাঁধানো এবং গাছ লাগানোর দাবি তুলেছেন ভুক্তভোগীরা। এ জন্য প্রশাসনের নানা মহলে দরবারও শুরু করেছেন।

এলাকার বিধায়ক অসীম মাঝি স্বীকার করেছেন, ভাঙন মোকাবিলা তাঁর বিধানসভা এলাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা। তাঁর কথায়, “এখানকার ১৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৩টিই গঙ্গার ধারে। স্থায়ী ভাবে ভাঙন মোকাবিলার জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা দরকার। কেন্দ্র সরকারই এটা পারে। এ জন্য কেন্দ্রের কাছে অনুরোধ জানানো হবে।” এর আগে কোনও চেষ্টাই যে কার্যকর হয়নি, তা মেনে নিয়ে হুগলির সাংসদ রত্না দে নাগের আশ্বাস, শীঘ্রই বিষয়টি ‌নিয়ে কেন্দ্রের কাছে নির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠাতে রাজ্যের জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।

গ্রামবাসীদের নতুন দাবি যে যুক্তিযুক্ত, তা মেনে নিয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) আবিদ হোসেন। তিনি বলেন, “ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থার জন্য একটা প্রকল্প রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।”

কলকাতার দিক থেকে গঙ্গার ধার বরাবর এগোলে বলাগড় হুগলির শেষ ব্লক। প্রত্যন্ত এই ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা ভাঙন কবলিত। গুপ্তিপাড়া, মিলনগড়, ডুমুরদহ-১, সিজা-কামালপুর, সোমড়া-১ বা জিরাট পঞ্চায়েত জুড়ে ছবিটা একই রকম। গোটা ব্লকের প্রায় ৩৫ কিলোমিটার জুড়ে বহু দিন ধরেই গঙ্গা নিয়মিত পাড় ভাঙছে।

জিরাটের খয়রামারির প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, এখানকার তিনটি মৌজার মধ্যে গৌরবনগর কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। রানিনগর মৌজারও অনেকটা তলিয়ে গিয়েছে জলে। দুর্লভপুরও যে কোনও দিন তার অস্তিত্ব হারাবে। কয়েক বছর আগে ভাঙন আটকাতে বাঁশের তৈরি বিশেষ খাঁচা জলে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হয়নি।

প্রতি বছর বর্ষার মরসুম শুরু হলেই আতঙ্কে থাকেন গ্রামবাসীরা। কেননা, বেশি বৃষ্টি হলে গঙ্গায় জলস্তর বাড়ে। জলের চাপে বাড়ে ভাঙনও। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে অন্যত্র বাস করা শুরু করেছেন। যাঁরা আছেন, তাঁরা চান, এ বার অন্তত ভাঙন ঠেকাতে পাকাপাকি সমাধানে উদ্যোগী হোক প্রশাসন। নদীর পাড়ে কংক্রিটের বোল্ডার ফেলা এবং গাছ লাগানোর দাবি নিয়ে তাঁরা ব্লকের তৃণমূল নেতা তপন দাস এবং জেলা পরিষদ সদস্য রুনা খাতুনের কাছে ইতিমধ্যেই দৌড়ঝাঁপও করেছেন। দু’জনেই দাবি পূরণে চেষ্টার আশ্বাস দিয়েছেন।

খয়রামারির বাসিন্দা প্রৌঢ় কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, “বালির ট্যাকে থাকতাম। মধ্যপাড়ায় আমার ধানকল ছিল। গঙ্গা সব কেড়ে নিল। তার পরে পিছিয়ে এসে ঘর করেছি।” বলাই মণ্ডল নামে আর এক গ্রামবাসীর কথায়, “বারবার নতুন করে বাড়ি বানাতে অনেক খরচ হয়। জোগাড় করতে হিমশিম খাই। সরকারি সাহায্য তেমন মেলে না। এ বার পাকাপাকি ভাঙন রোধ করা হোক।” খেয়াঘাটের পাশেই বৃদ্ধ শিবনাথ বিশ্বাসের চায়ের দোকান। ভাঙন ঠেকাতে এক সময় অনেক আবেদন-নিবেদন করেছেন। এখন আর তেমন রুচি নেই। তিনি বলেন, “ক’দিন আগেই দোকানটা সরিয়ে এখানে নিয়ে আসতে হল। এমনই জীবন আমাদের।” পাশ থেকে এক গ্রামবাসীর স্বগতোক্তি, “লোকে শখ করে বাসা বদল করে। এখানে গঙ্গা আমাদের বাড়ি বদলে দেয়।”

বছরের পর বছর গঙ্গার সঙ্গে লড়াই করে গরিব মানুষগুলো এখন ক্লান্ত। চান লড়াইয়ের ইতি। চান ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা। প্রশাসন কী করে, এখন সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE