Advertisement
E-Paper

ভক্তদের দাপটে অতিষ্ঠ নিত্যযাত্রীরা

‘ভোলে বাবা পার করেগা’, ‘পার করেগা ভোলে বাবা’....কলকাতার বড়বাজারের দিক থেকে ভেসে আসছিল ছোটখাটো রঙিন মিছিলটা। মিছিলে সবার আগে এক ভক্তর হাতে লাঠিতে জড়ানো লাল রঙের তিনকোনা পতাকা। মাঝেমধ্যেই মজবুত ওই লাঠি শাসন করছে মিছিলের পিছনের অংশটিকে। যেখানে অপটু হাতের প্লাস্টার অব প্যারিসে তৈরি বাবার (শিব) মূতির্র্ কাঁধে কয়েকজন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৪ ০২:৪৯
 ট্রেনের মধ্যেই চলছে গাঁজার টান। ছবি: দীপঙ্কর দে।

ট্রেনের মধ্যেই চলছে গাঁজার টান। ছবি: দীপঙ্কর দে।

‘ভোলে বাবা পার করেগা’, ‘পার করেগা ভোলে বাবা’....

কলকাতার বড়বাজারের দিক থেকে ভেসে আসছিল ছোটখাটো রঙিন মিছিলটা। মিছিলে সবার আগে এক ভক্তর হাতে লাঠিতে জড়ানো লাল রঙের তিনকোনা পতাকা। মাঝেমধ্যেই মজবুত ওই লাঠি শাসন করছে মিছিলের পিছনের অংশটিকে। যেখানে অপটু হাতের প্লাস্টার অব প্যারিসে তৈরি বাবার (শিব) মূতির্র্ কাঁধে কয়েকজন। হাওড়া ব্রিজের উপর মিছিল আসতেই লাল পতাকা লাগানো লাঠি সরাসরি আছড়ে পড়ল একটি ট্রাকের সামনে। উল্টোদিক থেকে আসা ট্রাকের চালক সজোরে ব্রেক কষেন। যানজটের আশঙ্কায় লাঠিধারি যুবকটির দিকে রে রে করে ছুটে এলেন ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মী। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। পুলিশকে নিরস্ত করতে মিছিল থেকে অনবরত বাজতে থাকল বাঁশি, তাসা। খানিকক্ষণ থেকে রণে ভঙ্গ দিলেন ওই পুলিশকর্মী। ব্রিজের দু’দিকে তখন বেশ কিছু গাড়ির লাইন। তবে তাতে তোয়াক্কা নেই বাবার ভক্তদের। চলমান কনসার্ট ব্রিজে গম গম করতে করতে বিজয়ীর ভঙ্গিতে তখন হাওড়া স্টেশনমুখো। ভিড় বাসের যাত্রী থেকে ট্যাক্সিচালকদের কেউ কেউ যখন মিছিলের আমোদ নিতে ব্যস্ত, তখন অফিসের সাহেবকে নিতে আসা কলকাতামুখী এক গাড়ির চালক মিছিল সামলানোয় পুলিশের নিস্পৃহতাকে অবিরাম গোলা বর্ষণ করে চলেছেন।

হাওড়া স্টেশনের সাবওয়েতে ঢোকার পর যেন মিছিল বিশ্বময়। সকলেই পড়ি কি মড়ি করে পৌঁছতে চায় বাবার কাছে যাওয়ার পানসি তারকেশ্বর লোকালের কাছে। কে নেই সেই দলে! বছর তেরো-চোদ্দোর কিশোর-কিশোরী থেকে একেবারে পঞ্চাশ পার হওয়া প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া। কোলে বছর-তিন-চারের ছেলেকে নিয়ে ছুটতে দেখা গেল এক মা ভক্তকেও। ছেলেকে বাবার আশীর্বাদ পাওয়ানোর কি দুরন্ত চেষ্টা।

সোমবার ‘বাবার বার’। তাই শনিবারই সঠিক দিন। আর সেই দিনেই গোটা স্টেশন জুড়ে ‘ভোলে বাবা পার করেগা’র অবিরাম স্রোত। বাবার ভক্তদের গুঁতোয় লড়াকু নিত্যযাত্রীরা নিতান্তই অসহায়। ট্রেনের সিট থেকে মেঝে সবই ‘লালবাহিনীর’ (সকলের পরনেই লাল গেঞ্জি ও লাল হাফপ্যান্ট) দখলে। শ্রাবণের নিদারুণ যন্ত্রণা এই শাখার যাত্রীদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। এমনকী মহিলাদেরও রেহাই নেই। এই একমাস মহিলা হিসাবে ট্রেনে তাঁদের অধিকারও বাবার কৃপায় খর্ব হয়ে যায়। এক নিত্যযাত্রীর বিলাপ, “আমিও বাবার ভক্ত। কিন্তু তাই বলে ওঁরা যেটা করেন সেটা কি ভক্তি, অনাচার নয়? যাঁরা মহিলা, শিশু, বৃদ্ধদের দিকে ফিরেও তাকান না তাঁরা আবার ভক্ত কিসের? স্রেফ নোংরামি করতে যান।” একটু থেমেই তাঁর ভ্রম সংশোধন, “তবে সকলেই নিশ্চয়ই নন। তবে এই সব অনাচারকারীদের সংখ্যা বাড়ছে এটা বলতে পারি।” তবে সহানুভূতিশীলও কেউ কেউ। একজনের গলায় শোনা গেল, “এই একটা তো মাস। চাকরি-বাকরির ঠেলায় বাবার কাছে যাওয়া হয় না। তবু এদের সঙ্গে থাকলে মনে হয় পূণ্য হচ্ছে।’’ যদিও ভক্তির গুঁতোয় প্রাণ ওষ্ঠাগতদের সংখ্যাই ভারী।

ট্রেনে উঠেও রেহাই নেই। রেল কর্তৃপক্ষের ট্রেনের গায়ে সাঁটানো নিষেধের বাণীকে থোড়াই কেয়ার করে অবাধে চলে গাঁজার আসর। প্রতিবাদের উপায় নেই, কারণ বাবার অত্যন্ত ‘প্রিয় জিনিস’। অগত্যা নাকে রুমাল চেপেই বসে থাকা। গাঁজার আসরের মধ্যেই এক ফাঁকে ভক্তদের ঝোলা থেকে বেরিয়ে আসে প্লাস্টিকের গ্লাস। তাতে বিদেশি ব্র্যান্ডের রঙিন পানীয় নিয়ে শুরু হয়ে যায় ‘চিয়ার্স’। না এ নিয়েও কিছু বলার উপায় নেই। কারণ একটাই শ্রাবণ মাস। বাবার বার। সাতখুন মাফ। এক যাত্রীর মন্তব্য, “কি বলবেন, পুলিশ-প্রশাসনও এদের ঘাঁটাতে সাহস করে না। হয়তো বলবে ধর্মীয় আবেগে আঘাত ‘নৈব নৈব চ’।”

আয়োজনে কোনও রাখঢাক নেই। নেই কোনও গোপনীয়তা। একাদশ শ্রেণির সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা ছাত্রের সঙ্গে অনায়াসে সঙ্গত করছেন মাঝবয়সী ভক্ত। শেওড়াফুলি, তারকেশ্বর স্টেশন চত্বরে প্রকাশ্যেই চলে গাঁজার কলকে বিক্রি। রাস্তাঘাট তো বটেই, রেল স্টেশনগুলোও হয়ে ওঠে গাঁজার আখড়া। সৌজন্যে শ্রাবণ মাস।

কিছুটা অসহায়ের মতো বলছিলেন পূর্ব রেলের এক কর্তা, “রেল পুলিশ বাধা দিতে গেলেই ভক্তদের জেদাজেদিতে প্রতিদিন নানা ঘটনা ঘটবে। এমনকী নিত্যযাত্রীদের সঙ্গে মারামারি ঘটনাও হামেশাই ঘটে। গোলমাল থামিয়ে দেওয়া ছাড়া পুলিশের আর কিছু করার থাকে না। মানুষের আবেগের ব্যাপারটা আছে।” পূূর্ব রেলের ডিআইজি রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “হাওড়ায় এবং প্রতিটি আপ ও ডাউন স্টেশনে আমরা বাড়তি পুলিশ দিই এই শ্রাবণ মাসে। ফলে অনেক ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে।” যদিও বাবার দামাল ভক্তদের আচরণের প্রতি পুলিশি ‘প্রশয়ের’ জোরালো অভিযোগ থেকে সরতে নারাজ সাধারণ ভক্তরা।

opium rail commuters chinsurah southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy