এক সময়ে গোটা আরামবাগ মহকুমায় স্বল্পমেয়াদি আখ চাষে পথ দেখিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু রোগপোকার আক্রমণ এবং ভাল জাতের বীজ না মেলায় এখন সেই পুড়শুড়ার চাষিরাই ওই চাষ থেকে ক্রমশ সরে আসছেন। গত পাঁচ বছরে পুড়শুড়ায় স্বল্পমেয়াদি আখ (যা মূলত চিবিয়ে খাওয়া হয়) চাষের এলাকা ৪০০ হেক্টর থেকে কমতে কমতে এখন মাত্র ৪০ হেক্টরে নেমেছে। ওই চাষিরা সব্জি এবং লঙ্কা চাষে ঝুঁকেছেন। চাষের এলাকা কমেছে মহকুমার অন্য ব্লকগুলিতেও।
চাষিদের অভিযোগ, পাঁচ-ছ’বছর আগে পর্যন্ত প্রায় নিখরচায় আখ চাষ করে বিঘাপ্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ক্রমাগত রোগপোকার আক্রমণে তাঁরা নাজেহাল। কৃষি দফতরের বাতলানো ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। তা ছাড়া, ভাল প্রজাতির আখবীজেরও সন্ধান মিলছে না। এই দুই সমস্যা এড়ানো গেলে তাঁরা ফের ওই আখ চাষে ফিরবেন বলেও জানান চাষিরা।
পুড়শুড়ায় স্বল্পমেয়াদি আখ চাষে বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন মহকুমা কৃষি আধিকারিক অশ্বিনী কুম্ভকার। তিনি বলেন, “পুড়শুড়ায় চিবিয়ে খাওয়ার আখ চাষকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কৃষি-খামারে উন্নত প্রজাতির বীজ (সি ও বি ৯৯১৬১) তৈরি করছি আমরা।” একই সঙ্গে তিনি জানান, অধিকাংশ চাষি একই জমিতে বছরের পর বছর আখ চাষ করায় রোগপোকার আক্রমণ বেশি হয়। বিশেষ করে আখের আগা ছিদ্রকারী পোকা (টপ স্যুট) বা লাল দাগ (রেড রট) দমন করা দুরূহ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য গ্রামে গ্রামে কর্মশালা করে চাষিদের পরামর্শ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানিয়ে অশ্বিনীবাবু বলেন, “চাষিরা জমি পাল্টে পাল্টে ওই আখ চাষ করলে লাভবান হবেন। সেই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”
মহকুমা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গুড় বা চিনি তৈরির আখ সারা বছর ধরে জমি দখল করে রাখে। সেই জায়গায় চাষিরা যাতে দ্রুত লাভ পান, সেই জন্য ১৯৯০ সাল নাগাদ পুড়শুড়ায় স্বল্পমেয়াদি (১৮০ দিন) আখ চাষের পরিকল্পনা করা হয়। যা মূলত চিবিয়ে খাওয়া হয়। শুরুতে পুড়শুড়ায় শ’খানেক চাষি ৫০ হেক্টর জমিতে পরীক্ষামূলক ভাবে স্বল্পমেয়াদি আখ চাষ করেন। তারপর থেকেই চাষের এলাকা বাড়তে বাড়তে ২০০৩ সাল নাগাদ শুধু পুড়শুড়াতেই ওই চাষের মোট এলাকা দাঁড়ায় ৪০০ হেক্টর। চাষের প্রধান মৌজাগুলি হল— জঙ্গলপাড়া, সাঁওতা, ফতেপুর, ভাঙ্গামোড়া, শ্যামপুর, সোদপুর ইত্যাদি। কিন্তু ২০০৬ সাল নাগাদ আখের লাল দাগ রোগ শুরু হয়। সেই রোগ বছর বছর এমনই ভয়াবহ রূপ নেয় যে ২০০৯ সাল নাগাদ চাষের এলাকা কমতে কমতে এখন মাত্র ৪০ হেক্টরে ঠেকেছে। গোটা মহকুমায় তা ঠেকেছে মাত্র ৯৯ হেক্টরে।
কেন স্বল্পমেয়াদি আখ চাষ থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন চাষিরা?
১৯৯০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পুড়শুড়ার যে সব চাষি স্বল্পমেয়াদি আখ চাষ করে লাভের মুখ দেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাঁওতা গ্রামের মানিক মাজি। তিনি জানান, ওই আখ ১৮০ দিনের ফসল হলেও ১০০ দিনের পর থেকেই সরাসরি জমি থেকে বিক্রি হয়ে চলে যেত হুগলির নানা বাজার ছাড়াও বর্ধমান, বাঁকুড়া, হাওড়া, দুই মেদিনীপুরে। আখ চাষের জন্য আলাদা করে জমি কর্ষণ করতে হয় না। ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ আলু তুলে সেই জায়গায় আখের বীজ ফেলে দিলেই হল। আলুর উদ্বৃত্ত সারই আখ চাষের জন্য যথেষ্ট। খালি আবহাওয়া অনুযায়ী কয়েকটি সেচ লাগে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন থেকে আখ খেতের ধারে ট্রাক-সহ বিভিন্ন গাড়ির লাইন পড়ত। এখন রুগ্ণ আখ কিনতে স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী সাইকেল, ম্যাটাডর নিয়ে আসেন।
আর এক চাষি রাজকুমার বাগ বলেন, “আলুর পর একই জমিতে প্রায় নিখরচায় আখ চাষ করে বিঘাপিছু ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পেয়েছি। ফলন হয়েছে ১১ থেকে ১২ টন। এখন ভাল বীজ না মেলায় ও রোগপোকার হানায় প্রায় অর্ধেক ফলন হয়। লাভও তেমন থাকে না। তাই আখের জায়গায় অনেকে লঙ্কা বা সব্জি চাষ শুরু করছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy