লিলুয়ায় রেলের ইয়ার্ডেই হয়েছিল প্রশিক্ষণ। তার পরে চাকরির নিয়োগপত্রও হাতে পেয়ে গিয়েছিলেন ওড়িশার বালেশ্বরের বাসিন্দা মানসরঞ্জন সাহু। কিন্তু প্রথম দিন লিলুয়ায় রেলের ইয়ার্ড-অফিসে যখন কাজে যোগ দিতে ঢুকছেন, তখন পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে হয়েছিল তাঁকে। পুলিশকর্মীরা তাঁকে সাফ বলে দিয়েছিলেন, চাকরির ওই নিয়োগপত্রটি ভুয়ো, তাই বাঁচতে গেলে পালাতে হবে।
প্রথমে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে গেলেও পরে মানসরঞ্জন জেনেছিলেন, নগদ এক লক্ষ টাকা উৎকোচ দেওয়ার পরে তাঁকে চাকরির যে নিয়োগপত্রটি দেওয়া হয়েছিল, সেটি সত্যিই ভুয়ো। এমনকী, কাজে যোগ দিতে গিয়ে যে পুলিশের তাড়া খেয়ে তিনি পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তারাও কিন্তু আসল পুলিশ নয়, প্রতারকদেরই দোসর।
ওই প্রতারণার ঘটনায় সিআইডি এখনও পর্যন্ত দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। শুক্রবার সকালে দেবাশিস দাস ওরফে দেবুকে বেলুড়ের গুহ রোড থেকে ধরা হয়। এর আগে লেক টাউন থেকে ওই প্রতারণা-চক্রেরই আর এক সদস্য সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে রায়বাবুকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। শনিবার দেবাশিসকে আলিপুর আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁকে ১৪ দিন সিআইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্তকারীরা জানান, সালকিয়া এলাকার একটি ক্লাবের সঙ্গে ফুটবল কোচ হিসেবেও যুক্ত ছিলেন ওই ব্যক্তি। তবে সিআইডি সূত্রে খবর, আগেও রেলে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণার কয়েকটি অভিযোগ দেবাশিসের বিরুদ্ধে বালি ও বেলুড় থানায় দায়ের করা হয়েছিল। বালির রামনবমীতলায় তাঁর ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু নকল নিয়োগপত্র এবং ভুয়ো কাগজপত্র, সিলমোহর বাজেয়াপ্ত করেন তদন্তকারীরা।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, দু’জন ধরা পড়লেও প্রতারণা-চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে আরও অনেকে। গোয়েন্দাদের একাংশের প্রশ্ন, রেল আদৌ যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাই করেনি, তা রেলেরই ইয়ার্ডে হল কী ভাবে? ভুয়ো পুলিশেরাই বা সেখানে এল কী করে এবং তারা লিলুয়া ইয়ার্ডে ঢুকতে যাওয়া চাকরিপ্রার্থীকেই বা তাড়া করল কী ভাবে? রেল ইয়ার্ডের কর্মীদের একাংশের ভূমিকা নিয়েই সন্দেহ করছেন গোয়েন্দারা।
পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, “লিলুয়ার এই নির্দিষ্ট ঘটনার কথা আমি জানি না। তবে রেলে চাকরি দেওয়ার নাম করে এমন প্রতারণার ঘটনা ইদানীং কিছু ঘটছে।” তাঁর বক্তব্য, কয়েক দিন আগেও এই ধরনের একটি প্রতারণা-চক্রের কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। রবিবাবু বলেন, “আমাদের ভিজিল্যান্স বিভাগ বিষয়টির উপরে নজর রাখছে।”
বালেশ্বরের বাসিন্দা মানসরঞ্জন গত এপ্রিলে বেলুড় থানায় প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে তিনি জানান, লিলুয়ায় রেল ইয়ার্ডে আরও কয়েক জনের সঙ্গে তাঁকেও কয়েক দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মিলেছিল চাকরির নিয়োগপত্রও। প্রশিক্ষণের আগে তাঁর কাছ থেকে এক লক্ষ টাকাও নেওয়া হয়েছিল।
তদন্তে সিআইডি জেনেছে, কয়েক জন যুবক একটি দল তৈরি করে রেলে চাকরি দেওয়ার নামে বহু মানুষের সঙ্গে এই ভাবে প্রতারণা করছে। মূলত, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরের কয়েক জন যুবক এখনও পর্যন্ত এর শিকার হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। তদন্তকারীরা জানান, নাম-কা-ওয়াস্তে কয়েক দিন লোক দেখানো প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরে নিয়োগপত্র ধরানো হত চাকরিপ্রার্থী যুবকদের। কিন্তু চাকরিতে যোগ দিতে গেলেই সাদা পোশাকের নকল পুলিশের কড়া চোখ রাঙানির সামনে পড়তে হত তাঁদের। বলা হত, ভুয়ো নিয়োগপত্র নিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে এসেছেন বলে তাঁদের গ্রেফতার করা হতে পারে। হাতেপায়ে ধরাধরি করলে ওই যুবকদের পালানোর পরামর্শ দিতেন ওই নকল পুলিশেরা। যাঁরা আসলে দেবাশিস, সুদীপদেরই লোক।