Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

গুদাম ছেড়ে দোকানে হানা কেন, আলু-নীতি ঘিরে প্রশ্ন

উপরে-উপরে বজ্র আঁটুনি। অথচ শিকড়ে সেই ফস্কা গেরো! পরিণামে জটিল থেকে জটিলতর চেহারা নিচ্ছে রাজ্যের আলু-সমস্যা। টাস্ক ফোর্সের কাজ দেখে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার নবান্নের বৈঠকে ফোর্সের সদস্যদের বলেছিলেন, “১৪ টাকা দরে আলু বিক্রি করতে বলেছিলাম! তার বদলে শুধু ২২ টাকাই করলেন না, বাইরের রাজ্যেও পাঠাতে শুরু করলেন! এ বার আমি যা করার করব।” খোদ মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরেও শুক্রবার কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে কুড়ি-বাইশেই জ্যোতি আলু বিকিয়েছে।

ওড়িশাগামী আলুবোঝাই ট্রাক আটকে পুলিশি পাহারায় কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে। শুক্রবার এগরায়।—নিজস্ব চিত্র।

ওড়িশাগামী আলুবোঝাই ট্রাক আটকে পুলিশি পাহারায় কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে। শুক্রবার এগরায়।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৪ ০৪:০০
Share: Save:

উপরে-উপরে বজ্র আঁটুনি। অথচ শিকড়ে সেই ফস্কা গেরো!

পরিণামে জটিল থেকে জটিলতর চেহারা নিচ্ছে রাজ্যের আলু-সমস্যা। টাস্ক ফোর্সের কাজ দেখে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার নবান্নের বৈঠকে ফোর্সের সদস্যদের বলেছিলেন, “১৪ টাকা দরে আলু বিক্রি করতে বলেছিলাম! তার বদলে শুধু ২২ টাকাই করলেন না, বাইরের রাজ্যেও পাঠাতে শুরু করলেন! এ বার আমি যা করার করব।” খোদ মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরেও শুক্রবার কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে কুড়ি-বাইশেই জ্যোতি আলু বিকিয়েছে।

এবং দাম যে খুব তাড়াতাড়ি নামবে, সে নিশ্চয়তা এ দিন দিতে পারেননি আলু-ব্যবসায়ীরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইতিমধ্যে বাইরের রাজ্যে আলু পাঠানো বন্ধ করেছে। তাতেও বিশেষ সুরাহা হয়নি। উপরন্তু চাহিদা এবং জোগানের সঙ্গে দামের যে স্বাভাবিক সম্পর্ক, তাতে সরকারি হস্তক্ষেপ কতটা যুক্তিযুক্ত? পাশাপাশি মজুতদারি প্রতিরোধে নজর না-দিয়ে স্রেফ খুচরো বাজারে কড়াকড়ি আরোপ করে লাভ কতটা হবে, সেই সংশয়ও প্রকট হয়ে উঠেছে ব্যবসায়ী মহলে।

বস্তুত মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকর করতে খুচরো বাজারকেই ‘পাখির চোখ’ করে কোমর বেঁধে ময়দানে নেমেছে রাজ্য প্রশাসন। উদ্যোগে সামিল কলকাতা পুরসভাও। পুর-কমিশনার খলিল আহমেদ এ দিন শহরের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও পুর-কর্তাদের বৈঠকে ডেকে ফরমান দিয়ে দেন, সরকার যে হেতু জ্যোতি আলুর দাম কেজিপিছু ১৪ টাকা বেঁধে দিয়েছে, তাই ওই দরেই আলু বেচতে হবে। যা শুনে একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রশ্ন, খুচরো দোকানিরা ১৪ টাকার বেশি দরে আলু কিনলে কী ভাবে একই দরে বেচবেন? পুর-কর্তৃপক্ষের অবশ্য সাফ কথা, এখানে কোনও ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। সরকার যখন বলেছে, তখন মানতেই হবে।

নির্দেশ মানতে যাতে সকলে বাধ্য হয়, তা সুনিশ্চিত করার তোড়জোড়ও শুরু হয়েছে জোরকদমে। পুর-কর্তৃপক্ষ এ দিন এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ (ইবি)-কেও বৈঠকে ডেকেছিলেন। পুর-সূত্রের খবর, ইবি’কে বলা হয়েছে আজ, শনিবার থেকে কলকাতার সমস্ত বড় বাজারে নজরদারি চালাতে। সরকারি নির্দেশ অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ইবি জানিয়েছে, চার দিন যাবৎ তারা জেলায় জেলায় নজরদারি চালাচ্ছে, শনিবার থেকে যা জোরদার করা হবে। প্রশাসনের প্রস্তুতির বহর দেখেই সংশয় জাগছে, সরকার কি সমস্যার উৎসে আঘাত করতে পারছে? “বড় বড় যে সব আড়তদার বা ব্যবসায়ী পাইকারিতেই ১৪ টাকার বেশি দরে আলু বেচছেন, তাঁদের গুদামে সরকার কেন হানা দিচ্ছে না? কেন শুধু খুচরো দোকানিদের সস্তায় আলু বেচতে বাধ্য করতে পথে নামছে?” প্রশ্ন তুলেছেন এক ব্যবসায়ী সংগঠনের এক কর্মকর্তা।

এ বার কিন্তু আলুর চাষ মোটামুটি ভাল হয়েছে। হিমঘর মালিকদের একাংশও জানিয়েছেন, রাজ্যের বিভিন্ন গুদামে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আলু মজুত। ফলে দাম বাড়ারই কথা নয়। তবু এতটা বাড়ল কেন?

নবান্নের কর্তাদের ব্যাখ্যা: খেত থেকে গৃহস্থের পাতে পৌঁছনোর মাঝে বিভিন্ন যে স্তর, তারই কোথাও বেখাপ্পা ভাবে লাভের গুড় খেয়ে গিয়েছে এক শ্রেণির লোক। তাতেই এই পরিস্থিতি। ওঁদের দাবি: চাষিরা এ মরসুমে মাঠে ৭-৯ টাকা দরে আলু বেচেছেন। হিমঘর থেকে বেরোনোর সময়ে তা উঠেছে সাড়ে দশ-এগারোয়। অথচ সেই আলুরই পাইকারি দর পৌঁছেছে কেজিতে ১৯-২০ টাকা! কৃষি-বিপণনের এক কর্তার আক্ষেপ, “হাতবদলের মাঝে ৮-৯ টাকা কাদের পকেটে ঢুকল, সেটা ধরা যাচ্ছে না। ওই মধ্যসত্ত্বভোগীদের চিহ্নিত করা দরকার।”

কিন্তু সে চেষ্টা না-করে সরকার আচমকা কেন বাইরের রাজ্যে আলু পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা চাপাল, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি তা বুঝে উঠতে পারছে না। এই সিদ্ধান্তে তারা সিঁদুরে মেঘও দেখছে। সংগঠনগুলির আশঙ্কা, এতে আখেরে নিজেদেরই বিপদ হবে। “পশ্চিমবঙ্গ আলু আটকে দিলে মহারাষ্ট্রও বলতে পারে, তারা পেঁয়াজ পাঠাবে না। অন্ধ্র মাছ পাঠাবে না, ডিম আটকে দেবে! তখন কী হবে?” জানতে চাইছেন এক বড় ব্যবসায়ী।

ওঁদের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তার ইঙ্গিতও মিলেছে এ দিন। নবান্নের এক কর্তা জানান, অন্ধ্র থেকে মাছ-ডিম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গমুখী বেশ ক’টি লরি ওড়িশায় জলেশ্বরের কাছে আটকে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ যে হেতু ওড়িশায় আলু যেতে দিচ্ছে না, তাই পাল্টা হিসেবে বিজেডি কর্মী-সমর্থকেরা সেগুলিকে আটকে রেখেছেন। স্থানীয় বিজেডি বিধায়ক অশ্বিনীকুমার পাত্র ঘটনার সত্যতা মেনে মন্তব্য করেছেন, “পশ্চিমবঙ্গ আমাদের চাহিদা মতো আলু পাঠাচ্ছে না। এটুকু সম্পর্ক না-রাখলে তো মুশকিল!”

উল্লেখ্য, গত বছরেও এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। পরে দু’রাজ্যের মুখ্যসচিবের হস্তক্ষেপে মিটমাট হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে সরকার শিক্ষা না-নেওয়ায় ব্যবসায়ী মহলের একাংশ বিস্মিত। তাঁরা এ-ও দাবি করেছেন, অন্য রাজ্যে আলু যেতে না-দেওয়ার কোনও বিজ্ঞপ্তি আইনগত ভাবে জারি করা যায় না। গত ৩১ জুলাই আলু-পেঁয়াজকে অত্যাবশ্যক পণ্য ঘোষণা করে জারি হওয়া সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে শুধু মজুতদারি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে, আমদানি-রফতানিতে বিধি-নিষেধের প্রসঙ্গ নেই।

তা সত্ত্বেও শত শত আলুবোঝাই ট্রাক রাজ্যের সীমানায় আটক। সরকারি সূত্রের খবর, বিহারের চিরকুণ্ডা, ঝাড়খণ্ডের জামশোলা, বড়গোড়া-সহ বিভিন্ন জায়গায় সারি সারি আলুর ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে ওড়িশাগামী বহু আলুভর্তি লরি আটকে। দাঁতন, মোহনপুর, বেলদা, নারায়ণগড়, খড়্গপুরেও তা-ই। পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির রাজ্য সম্পাদক বরেন মণ্ডল বলেন, “তিন-চার দিন ধরে পশ্চিম মেদিনীপুরে ৩৫০ ট্রাক থেমে আছে। এ বার আলু পচে যাবে।” খড়্গপুরের এএসপি বরুণচন্দ্র শেখরের বক্তব্য, “যেমন নির্দেশ আসছে, আমরা তেমন পদক্ষেপ করছি।” কী সেই পদক্ষেপ?

ব্যবসায়ীরা জানান, প্রশাসনের ফরমান, আটক আলু স্থানীয় বাজারে বেচতে হবে, বা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নইলে প্রশাসনই আলু হুকুমদখল করে বেচবে। ব্যবসায়ীরা পড়েছেন সঙ্কটে। ওঁদের যুক্তি, ওই আলু ফিরিয়ে আনতে দিন দুয়েক লাগবে। তার মধ্যে আর্দ্রতায় আলু পচে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা। তবু লোকসানে স্থানীয় বাজারে বিক্রি না-করে ট্রাক ফিরিয়ে আনার ঝুঁকি নিচ্ছেন অনেকে। ইবি’র খবর, বরাকর-ঝাড়খণ্ড সীমানায় ডুবুরডিহি চেকপোস্ট থেকে এ দিন গোটা চল্লিশ ট্রাক ফিরে গিয়েছে।

‘সরকারি দমন-নীতি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হচ্ছেন আলু-ব্যবসায়ীরা। পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি এ দিন বাঁকুড়ার কোতুলপুরে বৈঠক করে ঘোষণা করেছে, আগামী সোমবার তারা রাজ্য জুড়ে কর্মবিরতি পালন করবে। সমিতির তরফে বরেনবাবু বলেন, “ওই দিন আমরা হিমঘর থেকে আলু বার করব না। পাইকারি বাজারেও আলু বিক্রি হবে না।”

তবে আমজনতার কথা মাথায় রেখে খুচরো বিক্রেতাদের আন্দোলন কর্মসূচি থেকে বাদ রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

potatoes retail market west bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE