Advertisement
০২ মে ২০২৪

আদর্শ গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সচেতনতার প্রতীক

রোজা ভেঙে যাঁরা রক্ত দিলেন, তাঁরাই আমাদের আশা! তাঁরা হঠাৎ আলোর ঝলক। তাঁরা অচিন্ত্যনীয় প্রকাশ। সাধারণের ভিড়ে থাকা অনন্যা! লিখছেন তিলোত্তমা মজুমদাররোজা ভেঙে যাঁরা রক্ত দিলেন, তাঁরাই আমাদের আশা! তাঁরা হঠাৎ আলোর ঝলক। তাঁরা অচিন্ত্যনীয় প্রকাশ। সাধারণের ভিড়ে থাকা অনন্যা! লিখছেন তিলোত্তমা মজুমদার

কোচবিহারে-রোজা-ভেঙে-রক্তদান।

কোচবিহারে-রোজা-ভেঙে-রক্তদান।

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৮ ০২:৪৫
Share: Save:

রোজা ভেঙে রক্ত দিলেন লাভলিরা— কোচবিহার জেলা সংক্রান্ত একটি ছোট খবর। গ্রীষ্মে হাসপাতাল ও ব্লাডব্যাঙ্কগুলিতে রক্তের আকাল দেখা দেয়। জলের মতোই। যদিও রক্ত ভূগর্ভজাত নয়, এক মানবদেহ অপর মানবদেহের জন্য তা দান করে, এমনকী বিক্রয়ও করে। গ্রীষ্মে মানব শরীরে রক্তাল্পতা হয়—এমনও নয়। তবু রক্তের হাহাকার তৈরি হয়।

কোচবিহার জেলা হাসপাতালেও এমনটাই হয়েছিল। মহিলাদের একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী এই বিপদে রক্তদানের আয়োজন করে এবং উপরে উল্লিখিত শিরোনাম সমেত সংবাদ হয়ে ওঠে।

আপাতদৃষ্টিতে এই রক্তদান শিবিরের উদ্যোগ সাধারণ ও স্বাভাবিক। কত সংগঠনই তো এমন শিবিরের আয়োজন করে। তা সত্ত্বেও, এই উদ্যোগটি মানবিকতার স্বাভাবিক প্রকাশ এবং অনন্যসাধারণ!

এই উদ্যোগী গোষ্ঠীকে আমরা আমাদের আদর্শ সামাজিক অবস্থানের প্রতিনিধি বলতে পারি। এর সদস্যরা ভিন্ন ধর্মের কিন্তু গোঁড়ামি ও বিভেদবোধের ঊর্ধ্বে। তাঁরা নারী এবং অনেকেই গ্রামবাসী। প্রায় প্রত্যেকেই নিম্নবিত্ত জীবনের সংগ্রামে জর্জরিত। রক্ত দান করা বিষয়ে তাঁদের যে অনুভব এবং উৎসাহ, তা শুধু সাধুবাদযোগ্যই নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ।

কেন, তা বিশ্লেষণ করার প্রয়াসে, প্রথমেই বলে রাখা ভাল, গ্রীষ্মে রক্তাভাব কেবল কোচবিহার শহরের সমস্যা নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা, এমনকী, সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে কলকাতার হাসপাতাল ও ব্লাডব্যাঙ্কগুলিরও সমস্যা।

গ্রীষ্মে রক্তাভাবের মূল কারণ অবৈজ্ঞানিক সংস্কার। শুধু গ্রীষ্মেই নয়, রক্তের ঘাটতি সারা বছরই কম-বেশি থাকে, তারও মূল কারণ রক্তদান সম্পর্কে জনসাধারণের অহেতুক ভীতি এবং অজ্ঞানতা! অনেকেই মনে করেন, রক্ত দিলে নিজের ক্ষতি করা হয়। সংরক্ষণযোগ্য সম্পদের মতোই মানুষ তা আসলে রাখে।

প্রতি ধরনের রক্তকোষের একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল থাকে, যেমন লোহিত রক্তকণিকার আয়ু বড় জোর চার মাস, তারপর সেই সব মৃত রক্তকোষ স্বাভাবিক ভাবে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, ক্রমাগত নতুন কোষ উৎপাদিত হতে থাকে।

একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের রক্তের পরিমাণ তার নিজস্ব চাহিদা পূরণ করার পরেও উদ্বৃত্ত হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পূর্ণবয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির শরীরের পাঁচ থেকে ছয় লিটার রক্ত থেকে দান হিসেবে নেওয়া হয় মাত্র ৩৫০ মিলিলিটার। একজন ব্যক্তি প্রতি তিন মাস অন্তর রক্তদান করতে পারেন।

প্রায় একশো ত্রিশ কোটি মানুষের দেশে তবু রক্তাভাব! অপসংস্কার ও অজ্ঞানতা প্রসূত ভীতি কোন সুদূরে প্রসারিত অনুমান করা যায়।

যাঁরা রক্তদান শিবির আয়োজন করেন, তাঁদের মন্ত্রী বা খ্যাতিমানের শরণাপন্ন হতে হয় লোক সমাবেশের জন্য, দাতার জন্য রাখতে হয় উপহার! পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল বলে মন্ত্রীরা ব্যস্ত ছিলেন, তাঁদের অনুগামীরাও। তাই ‘রক্তদান’ স্থগিত ছিল। যে কোনও নির্বাচনেই এমন পরিস্থিতি হবে। এমনটাই দস্তুর!

এই চাহিদার সূত্রে গড়ে উঠেছে রক্ত নিয়ে ব্যবসা। দারিদ্র্যের জ্বালায় যাঁরা রক্ত বেচেন, তাঁরা যেমন আর্থ-রাজনৈতিক নৈরাশ্য ও ব্যর্থতার পুরোগামী উদাহরণ, তেমনই, রক্ত ব্যবসায়ের অন্য একটি দিকও তার দৃষ্টান্ত! এই ব্যবসায়ের প্রথম দুষ্টচক্রী দালালরা। তারা হাসপাতাল বা ব্লাডব্যাঙ্কের কর্মী হতে পারে, না-ও পারে। আশু প্রয়োজন মেটাতে তারা রক্তের স্বাভাবিক দাম চড়িয়ে ক্রেতাকে অতিরিক্ত অর্থদণ্ড দিতে বাধ্য করবে। আর উচ্চমূল্য বেসরকারি হাসপাতালের আপাত পরিশীলিত চক্র এক ইউনিট রক্তের যে দাম হাঁকবে, তা সরকারি ব্ল্যাডব্যাঙ্কের নির্ধারিত দামের প্রায় দেড় গুণ!

বড়ই ভয়ের, বড়ই হতাশার!

এই প্রেক্ষাপটে কোচবিহারের মহিলারা যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন, তাতে মনুষ্যত্বর উজ্জীবিত সত্তাকে কুর্নিশ জানাবার সুযোগ পেল সমাজ।

রক্তের জাত নেই, ধর্ম নেই, উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র ভেদ নেই। রক্ত দান করবে বলে যে মেয়েরা রোজা রাখেননি, ‘বেঁচে থাকার লড়াইয়ের বাইরে’ কিছু করে যে মেয়ে তৃপ্ত, তাঁরা সেই আদর্শ গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ সচেতনতার প্রতিনিধি। মানবতার প্রতিনিধি। তাঁরাই আমাদের আশা! তাঁরা হঠাৎ আলোর ঝলক। তাঁরা অচিন্তনীয় প্রকাশ। সাধারণের ভিড়ে থাকা অনন্যা! সদ্যবিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে হানাহানি, গুন্ডামি, নিকৃষ্ট জবরদখলি রাজনীতির মধ্যে যেমন হঠাৎ প্রকাশিত হয়েছিলেন অনিতা দেবনাথ। ন্যায়, নীতি ও বিবেকবোধ তাঁকে আলোড়িত করেছিল। তিনি বলেছিলেন এমন জয়ের গৌরব তাঁর প্রয়োজন নেই যা নীতিবিগর্হিত উপায়ে লাভ হয়!

ক্ষমতাসীন দলের একজন সদস্য ও প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এই সাহসী এবং একক ধিক্কার সম্ভবত অচিরেই তাঁকে কোণঠাসা করেছে। কিন্তু ওই এক চিলতে সততার আলো সাধারণ মানুষের জাগ্রত বিবেক হয়ে উঠতে পারে যে কোনও দিন।

বহু প্রতিশ্রুতির পরেও উত্তরবঙ্গে কোনও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। চা-বাগানগুলি বন্ধ অথবা রোগগ্রস্ত। দূষণে দলে দলে মারা পড়ছে প্রিয় বোরোলি মাছ। পরিবেশের দূষণ কেবল নদীজলে নয়, অরণ্য ধ্বংসে নয়, রাজনীতি ও প্রশাসনের লুটমারে নয়, ঢুকে পড়েছে অসহায় মানুষের শিরায়-উপশিরায়। শুরু হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য ন্যায়-নীতিবিবর্জিত আপোস।

দলে দলে মেয়েরা পাচার হয়ে যাচ্ছে কোথায়, কোন পেশায়, দুনিয়ার কোন প্রান্তে! কোনও হিসেব নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই। বেঁচে থাকার জন্য, পরিবারের সহায়তার জন্য সে-ও তো একরকম সম্ভ্রমহীন রক্তদান!

সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অর্থনীতি এবং আদর্শহীন, দিশাহীন সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে উত্তরবঙ্গ ধুঁকছে। ভরসা ওই পুঁটিমারির লাভলি, গোসানিমারির মিনু, সুটকাবাড়ির হাসিনা বানু এবং আরও দু’শো সাতচল্লিশ জন সাহসিনী রক্তদাতা, ভরসা অনিতা দেবনাথরাও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cooch Behar Democratic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE