সবই তাঁর ইচ্ছে!
বুধ এবং বৃহস্পতি দু’দিনের নদিয়া জেলা সফরের যাবতীয় পূর্বসূচি ওলট-পালট করে মঙ্গলবার রাতেই কৃষ্ণনগর চলে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার নিট ফল– গত কয়েক দিন ধরে তাঁর সফর ঘিরে চলা যাবতীয় ব্যবস্থাপনা সামাল দিতে গিয়ে কালঘাম ছুটল কমবেশি সকলেরই। বুধবার মুখ্যমন্ত্রী কখন আসবেন, কোথায় যাবেন, কী করবেন তা নিয়ে প্রশাসনের কর্তা থেকে দলের তাবড় নেতা-মন্ত্রী কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। তৃণমূলের এক জেলা নেতা হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘‘দিদিকে মেলানো কি অতই সহজ!’’
কথা ছিল, জেলা সফরের প্রথম দিন, বুধবার তিনি সরাসরি হেলিকপ্টারে নামবেন নবদ্বীপের চটির মাঠে। সেখান থেকে তিনি রবীন্দ্র সংস্কৃতি মঞ্চে প্রশাসনিক বৈঠক সেরে দুপুরে নবদ্বীপে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের অতিথি আবাসে মধ্যাহ্ন ভোজন সারবেন। তারপর বিকেল সাড়ে তিনটের সময় ফের চটির মাঠে সভা করে সড়ক পথে কৃষ্ণনগরে গিয়ে সার্কিট হাউসে উঠবেন। প্রস্তুতিও চলছিল সেই মতো। নবদ্বীপের হেলিপ্যাডে কপ্টার নামিয়ে মহড়াও হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু রাতারাতি সব পাল্টে গেল তাঁর ইচ্ছায়! কিন্তু নতুন সফরসূচি কী হয়েছে, বুধবার দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী নবদ্বীপে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত তার কোনও হদিশ মেলেনি। জেলা প্রশাসনের তরফে শুধু এটাই জানানো হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রীর সব অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের থেকে এগিয়ে এসেছে।
শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী নবদ্বীপে পৌঁছলেন সড়ক পথে। ঘড়িতে তখন প্রায় বেলা দেড়টা। রবীন্দ্র সংস্কৃতি মঞ্চের সামনে নেমেই অপেক্ষায় থাকা জনতার দিকে হাত নেড়ে সটান তিনি ঢুকে পড়েন অডিটোরিয়ামে। প্রশাসনিক বৈঠকের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “আমি সময়ের অনেক আগেই চলে এসেছি। ফলে সবাই এখনও এসে পৌঁছতে পারেননি। সকলে এলে বৈঠক শুরু হবে। ততক্ষণ আপনারা বসুন। বৈঠক শুরু হলে ছবি তুলে সাংবাদিক বন্ধুরা যাবেন।” বৈঠক শেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর ঠিক আগেই বেরিয়ে আসেন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশাসনিক বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন করতেই দাঁড়িয়ে পড়েন সুব্রতবাবু। বলেন, “নদিয়া জেলায় দারুন কাজ হয়েছে। এই জেলাকে দেখে সারা দেশের শেখা উচিত। নদিয়া দেশের রোল মডেল হওয়া উচিত।”
প্রশাসনিক বৈঠক শেষে বিকেল ৩টে ৪০ নাগাদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চটির মাঠের সভাস্থলে পৌঁছন। মাঠে তখন কমপক্ষে বিশ হাজার মানুষের ভিড়। এ দিকে, মুখ্যমন্ত্রী হেলিকপ্টারে আসবেন বলে দুপুর থেকে হেলিপ্যাডের সামনে অপেক্ষা করে ছিলেন বহু মানুষ। ‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন’—মাইকে এই ঘোষণা শোনা মাত্রই সেই ভিড় হেলিপ্যাড ছেড়ে ছুটে আসে সভা-মঞ্চের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে মঞ্চের ডান দিকে আরও কয়েক হাজার মানুষ আছড়ে পড়ে। পুলিশ কিছু বোঝার আগেই বাঁশের ব্যারিকেড টপকাতে শুরু করেন কেউ কেউ। মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী বার বার তাঁদের থামতে বলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মঞ্চ থেকে নেমে জনতাকে শান্ত করতে ছুটে আসেন মন্ত্রী, জেলা নেতা, এমনকী জেলাশাসক। ততক্ষণে সেই উৎসাহী জনতা অবশ্য মঞ্চের ডান দিকে বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য পেতে রাখা চেয়ার তুলে হাতে হাতে পিছনের দিকে ফেলতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সি ভি মুরলিধর-সহ জেলা পুলিশের কর্তারা পরিস্থিতি সামাল দেন।
এ দিনের সভার প্রথম পর্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চ থেকে ১৬৬টি প্রকল্পের ঘোষণা এবং শিলান্যাস করেন। ভাষণের শুরুতে তিনি বলেন, ‘‘নদিয়া জেলা সারা ভারতের মডেল হওয়া উচিত। নির্মল বাংলা গড়তে নদিয়া জেলা একশোয় একশো পেয়েছে। দেশের মধ্যে প্রথম উন্মুক্ত শৌচাগার মুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষিত হতে চলেছে নদিয়া।’’ তিনি বলেন, ‘‘কাজ হচ্ছে নবদ্বীপেও। এখানে পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃত কলেজ হচ্ছে চৈতন্য মহাপ্রভুর নামে। আর কলকাতায় হবে সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে রবীন্দ্রভবন করে দিয়েছি। আর একটা রাস্তা বাইপাস রাস্তা, গঙ্গার পার বরাবর আমার কাছে প্রস্তাব এসেছে। আমি দেখছি সেটা কী ভাবে করে দেওয়া যায়।’’ এরপর তিনি ওই মঞ্চ থেকে চৈতন্যদেবের শহর নবদ্বীপকে হেরিটেজ টাউন ঘোষণা করেন।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘অনেকে আমায় বলেন, ‘দিদি আপনার চেহারা খারাপ হয়ে গিয়েছে।’ আমি বলি যত দিন পশ্চিম বাংলার চেহারা ভাল হবে না, ততদিন আমার চেহারাও ভাল হবে না। মানুষ ভাল থাকলে আমি ভাল থাকি।’’মুখ্যমন্ত্রী এ দিনও ব্যবসার কথা বলতে গিয়ে চায়ের দোকানের কথা বলেন। বলেন, ‘‘অনেকে ভাবেন আট হাজার টাকার চাকরির থেকে চায়ের দোকান ভাল। এতে বেশি ইনকাম হয়। যে যেমন ভাবেন, তেমন করুন। আমরা চাই মানুষ ভাল থাকুক।’’
এ দিন বন্ধের তীব্র বিরোধিতা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কেউ কেউ রাজনীতির স্বার্থে কাল একটা বন্ধ ডেকে রেখেছেন। আমি হাতজোড় করে বলছি, ওই বন্ধকে কেউ সমর্থন করবেন না। দোকান খোলা রাখুন, বাজার খোলা রাখুন, হাসপাতাল খোলা রাখুন, স্কুল খোলা রাখুন। আমি পরিষ্কার বলছি, ভয় পাবেন না। যদি কারও গাড়ি আক্রান্ত হয়, কারও দোকান ভাঙচুর হয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু বন্ধকে সমর্থন করবেন না।’’