Advertisement
০৭ মে ২০২৪

প্রকৃতির উল্টোরথেই পুড়ছে বাংলা

এক চোখরাঙানিতেই সে যেন শহরগুলোর নাম উল্টেপাল্টে দিয়েছে! পূর্ব ভারতের কলকাতাকে কোন এক ক্রুদ্ধ জাদুমন্ত্রে করে দিয়েছে জয়পুর-জয়সলমের আর পশ্চিমের জয়পুর-জয়সলমেরকে করেছে কলকাতা!!

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৫৪
Share: Save:

এক চোখরাঙানিতেই সে যেন শহরগুলোর নাম উল্টেপাল্টে দিয়েছে! পূর্ব ভারতের কলকাতাকে কোন এক ক্রুদ্ধ জাদুমন্ত্রে করে দিয়েছে জয়পুর-জয়সলমের আর পশ্চিমের জয়পুর-জয়সলমেরকে করেছে কলকাতা!!

সে মানে রুদ্র গ্রীষ্ম। সে মানে তাপমাত্রা। ঊর্ধ্বমুখী পারদস্তম্ভ। সে হঠাৎ উলটপুরাণ খুলে বসায় সজল বাংলার নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।

কেমন সেই উলটপুরাণ?

• বাতাসে আর্দ্রতা বেড়েছে। অথচ তাপমাত্রা কমার কোনও লক্ষণ নেই।

• বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ঢুকছে। ঝাড়খণ্ডের তাপমাত্রাও ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। কিন্তু কালবৈশাখীর মেঘ তৈরি হচ্ছে না। ফলে অস্বস্তিসূচক বাড়ছে লাফিয়ে।

• বৃষ্টির সুবাদে কাশ্মীর ও উত্তর ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে দ্রুত তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে। পশ্চিমি ঝঞ্ঝার জেরে পাকিস্তান থেকে রাজস্থান পর্যন্ত তৈরি হয়েছে একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা। রাজস্থান আর গুজরাতে তাপমাত্রা বাড়তে পারছে না। কিন্তু ওই নিম্নচাপ অক্ষরেখা পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রভাবকে আটকে রেখেছে রাজস্থান ও আশেপাশেই। ফলে উত্তর ভারতের অন্যান্য রাজ্য, মধ্য ও পূর্ব ভারত ওই পশ্চিমি ঝঞ্ঝার কোনও সুফলই পাচ্ছে না।

মূলত আবহাওয়ার এই তিন চাকার উল্টোরথের দাপটেই ত্রাহি-ত্রাহি রব উঠেছে দক্ষিণবঙ্গে। শিল্প স্থাপনে না-হোক, তাপমাত্রা বৃদ্ধির লড়াইয়ে শুখা রাজ্য রাজস্থান-গুজরাতকে হারিয়ে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা! গুজরাত ও রাজস্থানের কোনও জেলাতেই এখন তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি নেই। ৩৫ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে তাপমাত্রা। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের ১১টি জেলার মধ্যে ১১টিই তাপপ্রবাহের কবলে!

প্রকৃতির রথ স্বাভাবিক সড়কে গড়ালে এমনটা হওয়ার কথাই নয়। বছরের এই সময়টায় সাধারণত রোদের তাপে পুড়ে যায় রাজস্থান, গুজরাত, মধ্য ভারত, উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানা। এ বার কিন্তু ওই সব রাজ্যে কোনও তাপপ্রবাহ নেই। আবহাওয়ার ঠিক উল্টো অবস্থান পূর্ব ভারতে। তিন দিন ধরে তাপপ্রবাহ চলছে ছত্তীসগঢ়, বিহার, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডে।

এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি!

পরিস্থিতিটা অদ্ভুত হল কেন?

আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের অনেকেই পরিস্থিতিটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। বাতাসে জলীয় বাষ্প ঢুকলে তাপমাত্রা কমবে, এটাই দস্তুর। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে যে উল্টো ঘটনা ঘটছে! তাপমাত্রা এখানে তো কমেইনি, উল্টে গরম বেড়েছে। ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপমাত্রা আর আর্দ্রতায় বেড়েছে অস্বস্তিসূচক। মানুষ ঘেমেনেয়ে একশা। অস্বস্তিসূচক ৬৫.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছে। যা এই সময়ের স্বাভাবিক অস্বস্তিসূচকের থেকে ১০ ডিগ্রি বেশি। অস্বস্তিসূচক স্বাভাবিকের থেকে যত বেশি হয়, আমজনতার ভোগান্তি তত বাড়ে।

অস্বস্তিসূচকের বাড়বাড়ন্ত কেন?

জলীয় বাষ্প তৈরি হলেও তা মেঘ তৈরি করতে পারছে না। মেঘ তৈরি না-হওয়ায় উন্মুক্ত থেকে যাচ্ছে সূর্য। তাই তাপমাত্রাকে রোখা যাচ্ছে না। সঙ্গে আর্দ্রতা বেশি থাকায় অস্বস্তিসূচক বেড়েছে, ব্যাখ্যা দিচ্ছেন আবহবিদেরা।

এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র কালবৈশাখী। কিন্তু কোথায় গেল সে?

বিজ্ঞান বলে, ছোটনাগপুর মালভূমিতে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়ালে বাতাস গরম হয়ে যায়। সেই বাতাস উঠে যায় উপরের দিকে। চৈত্র-বৈশাখে দখিনা বাতাসে ভর করে বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ঢোকে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে। সেই জলীয় বাষ্প ছোটনাগপুর মালভূমিতে উপরের দিকে ওঠা গরম বাতাসের সংস্পর্শে এসে উঠে যায় আরও উপরে। বাতাস আরও উপরে উঠলে ঠান্ডায় তা জমে যায়। তৈরি হয় উল্লম্ব মেঘ। সেই মেঘপুঞ্জ অতঃপর দক্ষিণবঙ্গের দিকে সরতে শুরু করে। তার সঙ্গে যোগ দেয় আরও জলীয় বাষ্প। এমন একটা সময় আসে, যখন সেই মেঘপুঞ্জ আর জলীয় বাষ্পকে ধরে রাখতে পারে না। মেঘ যেখানে ভেঙে পড়ে, সেখানে শুরু হয়ে যায় ঝড়বৃষ্টি। এটাই কালবৈশাখী।

ঝাড়খণ্ডের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়ালেও এত দিন পরিমণ্ডলে জলীয় বাষ্প ছিল না। তাই কালবৈশাখী তৈরি হচ্ছিল না। কিন্তু বাতাসে এখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ যথেষ্টই। তবু ছোটনাগপুর এলাকায় কালবৈশাখীর মেঘ তৈরি হচ্ছে না কেন?

কালবৈশাখী নিয়ে যাঁরা কাজকর্ম করেন, তাঁদের অনেকেই বলছেন, বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ঢুকলেও ঝাড়খণ্ডে পৌঁছনোর আগেই প্রচণ্ড গরম বাতাসের সংস্পর্শে এসে তা শুকিয়ে যাচ্ছে। কালবৈশাখী হতে গেলে ছোটনাগপুর এলাকায় উল্লম্ব মেঘ তৈরি হওয়াটা জরুরি। কিন্তু জলীয় বাষ্পের অভাবে সেই মেঘই তৈরি হতে পারছে না।

কাশ্মীরের তুষারপাতের ফলে যে-ঠান্ডা বাতাস তৈরি হয়েছে, তা পূর্ব ভারতে পৌঁছচ্ছে না কেন?

আফগানিস্তান হয়ে কয়েক দিন ধরেই একের পর এক পশ্চিমি ঝঞ্ঝা ঢুকছে কাশ্মীরের পাহাড়ে। তার জেরে বরফ পড়ছে বিভিন্ন এলাকায়। বৃষ্টির দরুন উত্তর ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলিতেও কনকনে ঠান্ডা পড়েছে। সাধারণত পাহাড়ে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা আছড়ে পড়লে তার প্রভাব সমতলে পড়ে। পশ্চিমি ঝঞ্ঝা উপর থেকে নেমে আসে নীচের দিকে। তাই উপগ্রহ-চিত্রে ওই ঝঞ্ঝা ধরা পড়ায় কিছুটা আশায় ছিলেন আবহবিদেরা। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন, সেই ঝঞ্ঝা নীচে নেমে এসে পূর্ব ভারতের দহনজ্বালা কিছুটা কমিয়ে দেবে।

কিন্তু দেখা গেল, পশ্চিমি ঝঞ্ঝা যে-নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি করেছে, তা রাজস্থান, গুজরাত, পঞ্জাব ও হরিয়ানার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। পূর্ব ভারত তার প্রসাদ পাচ্ছে না।

আবহাওয়ার এই ভেল্কির কোনও সুনির্দিষ্ট কারণ দেখতে পাচ্ছেন না আবহবিদেরা। তবে তাঁদের অনেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন সেই দুষ্টু ছেলে ‘এল নিনো’ (প্রশান্ত মহাসাগরে জলতলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি)-কে। যার দৌরাত্ম্যে এ বার কড়া শীত থেকে বঞ্চিত হয়েছে ভারত-সহ অনেক দেশই। বসন্তের শুরুতেই শুকনো গরম বাতাস ঢুকে পড়েছে দক্ষিণবঙ্গে। আর অনিশ্চিত করেছে বর্ষার ভাগ্য।

দিল্লির মৌসম ভবন এ দিন চলতি বছরে বর্ষার প্রথম পূর্বাভাস ঘোষণা করেছে। তাতে অবশ্য এল নিনোর তেমন কোনও প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। মৌসম ভবনের ঘোষণায় বলা হয়েছে, এ বার দেশে স্বাভাবিকের থেকে বেশি বৃষ্টি হবে। খরাকবলিত মহারাষ্ট্রে ভাল বর্ষণের সম্ভাবনা থাকলেও পূর্ব ভারতের বৃষ্টি-ভাগ্য আপাতত খুলছে না বলেই প্রথম পূর্বাভাসে জানিয়ে দিয়েছে মৌসম ভবন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

heat waves
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE