শিশুদের দ্বর নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। প্রতীকী চিত্র।
রাজ্য জুড়ে শিশুদের মধ্যে জ্বরের সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ— বিভিন্ন হাসপাতালে জ্বর এবং অন্যান্য সংক্রমণ নিয়ে একাধিক শিশু ভর্তি। তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারই মধ্যে এ বার মালদহে জ্বর নিয়ে ভর্তি হওয়া তিন শিশুর মৃত্যু হল। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যেই রয়েছে। মালদহ মেডিক্যালে জ্বর, শুকনো কাশি এবং শ্বাসকষ্টের উপসর্গ নিয়ে এই মুহূর্তে শতাধিক শিশু ভর্তি। বুধবার থেকে এখনও পর্যন্ত তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার মারা গিয়েছে হবিবপুরের ডাল্লার বাসিন্দা আদিত্য মণ্ডল নামে সাড়ে তিন বছরের এক শিশু। ওই দিনই কাজিগ্রাম চণ্ডীপুরের ইফরাজ শেখ নামে সাত মাসের এক শিশুরও মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবার সকালে মারা গিয়েছে মালদহের ইংরেজবাজার থানার দক্ষিণ বালুরচরের বাসিন্দা মঙ্গল ডোম নামে এক শিশু। মঙ্গলের বয়স পাঁচ মাস।
তিন শিশুর মৃত্যুতে উদ্বেগ ছড়িয়েছে অভিভাবকদের মধ্যে। মঙ্গলের আত্মীয় অর্চনা মল্লিক বলেন, ‘‘দু’দিন ধরে জ্বরে ভুগছিল ছেলেটা। শ্বাসকষ্টও ছিল। আজ সকাল ছ’টা নাগাদ মারা গেল।’’ তবে মালদহ মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গত কাল দু’টি শিশু মারা গিয়েছে। আজও এক জন মারা গিয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছি।’’ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য হাসপাতালের তরফে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল তৈরি করা হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। পার্থপ্রতিমের দাবি, ‘‘জ্বরে আক্রান্তদের সংখ্যা স্বাভাবিক। এমনিতেই ৫০-৬০ জন করে ভর্তি হয়। আমরা সব ধরনের পরীক্ষাই করছি। মালদহ মেডিক্যাল কলেজে যে সব রোগী ভর্তি তাদের নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই।’’
মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ সুষমা সাহ বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক করে বলেন, ‘‘তিনটি শিশুকেই সঙ্কটজনক অবস্থায় ভর্তি হয়েছিল। তিন শিশুর মধ্যে দু’জন নিউমোনিয়া এবং এক জন ডিহাইড্রেশনে মারা গিয়েছে।’’ বেলা ২টো পর্যন্ত হাসপাতালে ১৬৪ জন শিশু ভর্তি রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর মত, ‘‘এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।’’
জলপাইগুড়ির পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগের কিছু দেখছেন না স্বাস্থ্য কর্তারা। উত্তরবঙ্গের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) সুশান্ত রায় বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আমরা ৪১ জনের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলাম। বুধবার গভীর রাতে রিপোর্ট এসেছে। তিন জনের শরীরে ইনফ্লুয়েঞ্জা বি ভাইরাস, তিন জনের শরীরের আরএসভি ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতি বছর হয়, সেটাই হয়েছে। এর উপসর্গ দেখে চিকিৎসা হয়। শিশুদের সাবধানে রাখুন। অসুস্থ হলে আলাদা করে রাখুন। কারণ এই রোগ সংক্রমিত হতে পারে।’’ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য চিকিৎসক দল তৈরি করেছে জলপাইগুড়ি জেলা স্বাস্থ্য দফতর।
জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের ভিড় বাড়ছে রায়গঞ্জ মেডিক্যাল কলেজেও। সেখানকার শিশু বিভাগে জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে ভর্তি শিশুর সংখ্যা ৩০ পেরিয়েছে। বহির্বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই এই অজানা জ্বরে আক্রান্ত বলে জানা গিয়েছে। তবে পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে রয়েছে বলেই জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কোচবিহারের এমজেএন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭৯ জন শিশু ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৫ জন জ্বরে আক্রান্ত।
মুর্শিদাবাদেও জ্বরে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে ৮০ শিশু। সকলের রক্ত ও লালারসের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। কান্দি মহকুমা হাসপাতালে ৩০ জন শিশু ভর্তি জ্বর এবং অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালের সুপারিন্টেনডেন্ট অমিয়কুমার বেরা বলেন, ‘‘এই জ্বর করোনার জন্য নয়। প্রতি বছর পুজোর আগে ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হন শিশুরা। গত এক সপ্তাহে ১০০ পেরিয়েছিল আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। বুধবার পর্যন্ত ৯৪ জন শিশু ভর্তি হয়েছিল। গত চব্বিশ ঘণ্টায় ৮০ জন শিশু ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা কিছুটা আশঙ্কাজনক।’’
পশ্চিম বর্ধমানেও অজানা জ্বরে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। তবে আশঙ্কার কারণ নেই বলেই জানিয়েছে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শেখ মহম্মদ ইউনুস। তিনি বলেন, ‘‘জ্বর, সর্দি এবং কাশির উপসর্গ নিয়ে সে ভাবে আর কেউ ভর্তি হচ্ছে না। অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। ভয়ের কোনও কারণ যে নেই, তা অনেকেই বুঝেছেন। বহির্বিভাগে চিকিৎসা করিয়েই তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন। প্রথম প্রথম একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। কারণ এই ধরনের উপসর্গ করোনা-সংক্রমণের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তবে কোনও শিশুরই করোনা ধরা পড়েনি। তাই ভয় কেটে গিয়েছে।’’
হুগলিতেও শিশুদের জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। বৃহস্পতিবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চুঁচুড়ার ইমামবাড়া সদর হাসপাতালে ভর্তি ৬৪ জন শিশু। হাসপাতালের সুপার উজ্জ্বলেন্দু বিকাশ মণ্ডল বলেন, ‘‘বর্ষা শেষ এবং পুজো আসছে,এই সময়ে ভাইরাস সংক্রমণ হয়। আক্রান্তের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত স্বাভাবিক। দু’টি একটি ক্ষেত্রে ডেঙ্গি এবং স্ক্রাব টাইফাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছে। আর সপ্তাহ খানেক বা দিন দশেক গেলে ছবিটা আমাদের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কার সম্ভাবনা কম।’’ বৃহস্পতিবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে ভর্তি ১৫ জন শিশু। তাদের বেশিরভাগেরই জ্বর, সর্দি, এবং শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ। ওই হাসপাতালে অবশ্য কোনও শিশুরই করোনা ধরা পড়েনি এখনি পর্যন্ত। ঋতু পরিবর্তনের ফলে শিশুদের এই অসুস্থতা বলে মত চিকিৎসকদের।
রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার ছবি দেখে আশঙ্কায় রয়েছে বীরভূমও। এ প্রসঙ্গে জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, ‘‘আমাদের জেলায় এখনও পর্যন্ত অজানা জ্বর নিয়ে কেউ ভর্তি হয়নি। তবুও অন্যান্য জেলার পরিস্থিতি দেখে আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করেছি। বীরভূমে দু’টি স্বাস্থ্য জেলা, রামপুরহাট ও বীরভূম। এলাকায় এমন জ্বরের প্রকোপ হচ্ছে কি না তা নজর রাখতে সব ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারও এমন জ্বর হয়েছে জানতে পারলেই তাকে প্রথমে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হবে। মেডিক্যাল টিমও গঠন করার নির্দেশ দিয়েছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy