নিশাচর: রাতের শহরে শেয়ালের দল। ফাইল চিত্র
রাতে রাস্তাঘাটে বেরোলেই চোখে পড়ে জ্বলজ্বলে জোড়া চোখের আনাগোনা। রাতে বাড়ি ফেরার সময় বালুরঘাটের চকভবানী এলাকার ত্রিধারাপাড়ার বাসিন্দা, পুরকর্মী রমেন মণ্ডল প্রথমটায় চমকেই গিয়েছিলেন। একটু ঠাহর করে তিনি বুঝতে পারেন রাস্তায় ফেলা খাবারে দু’টি কুকুরের সঙ্গে ভাগ বসাতে দাঁড়িয়ে আছে গোটা চারেক পুঁচকে শেয়াল। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট শহরে হাল আমলে এই ঘটনার সাক্ষী অনেকেই।
আত্রেয়ী নদীর ধারে চকভবানী বাজারপাড়া মোড় হোক বা দিশারী পাড়া। রাত বাড়তেই খাঁড়ির জঙ্গল থেকে পাড়ার রাস্তায় ভিড় করে শেয়ালেরা। প্রায়শই তা বাসিন্দাদের চোখেও পড়েছে। রমেন মণ্ডল বলেন, ‘‘শেয়াল দাঁড়িয়ে থাকলেও সেদিকে কুকুরেরও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। রোজ শেয়ালের আনাগোনা থাকায় হয়তো ঝামেলা করে না।’’
দিশারীপাড়ার বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক তমাল মণ্ডল রোজ রাতে রাস্তার মোড়ের মাথায় পাড়ার কুকুরদের জন্য দু’মুঠো ভাত দেন। তিনিও দেখেছেন শেয়াল। তাঁর মতে, খাবারের টানে খাঁড়ি থেকে উঠে আসছে শেয়াল। সমদূরত্ব বজায় রেখে সুযোগ বুঝে কুকুরদের খাবারেও ভাগ বসাচ্ছে তারা। ডাঙা ফরেস্ট অফিস বাংলো শহর লাগোয়া। সেখানে রাতে পাঁচিল টপকে ঢুকে ফেলে দেওয়া খাবারের অংশ খেয়ে যায় শেয়াল। এই দৃশ্য এখন কর্মীদের গা সওয়া। নিশুতি রাতে শহরের ফাঁকা রাস্তায় কুকুরের চিৎকার ছাড়াও এখন শোনা যায় শেয়ালের ডাক।
বালুরঘাট বনদফতরের রেঞ্জার আব্দুর রেজ্জাক জানান, শেয়ালের প্রিয় খাদ্য মেঠো ইঁদুর। ইঁদুরকে গর্ত থেকে বের করতে প্রয়োজনে সারারাত চেষ্টায় কোনও খামতি থাকে না শেয়ালের। মাঠের ইঁদুর খেয়ে ফসল রক্ষা করে বলে ‘কৃষকের বন্ধু’ তালিকায় শেয়াল জায়গা করে নিয়েছে। তিনি জানান, এক সময় জেলায় শেয়াল কমে যাওয়ায় ইঁদুরের দাপটে ফসল ধ্বংস হয়ে পড়ছিল। বছর চারেক আগে বিভিন্ন এলাকার জঙ্গলে শেয়াল ছাড়া হয়। তাতে সংখ্যায় বেড়ে গিয়ে এখন ভরপুর শেয়ালের সংসার।
জেলায় তিনটি বড় নদী আত্রেয়ী, পুনর্ভবা ও টাঙনের পাড়ে গর্ত করে শেয়ালেরা পরিবার নিয়ে থাকে। রেঞ্জারের বক্তব্য, ‘‘ধানের জমিতে বাস করা ধেড়ে ইঁদুর মারছেন চাষিরা। কীটনাশকেও ইঁদুরের সংখ্যাও কমছে। এর ফলে শেয়ালের খাবারে টান পড়েছে।’’ তিনি আরও জানান, নয়ানজুলি, ডোবা, খাঁড়ির মাছের উপর একসময় শেয়ালের খাবারের নিশ্চিত জোগান ছিল। তাতেও টান পড়েছে। ফলে খাবার খুঁজতে বাধ্য হয়ে শহরমুখী হচ্ছে শেয়ালকুল। গৃহস্তের কড়া নজরদারিতে তাদের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে হাঁস-মুরগিও।
কিছুদিন আগে বালুরঘাটের ভাটপাড়া এলাকার ডাঙির মাঠ থেকে শেয়াল ছাগল ছানাকে তুলে নিয়ে গেলে পাড়াশুদ্ধ লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল শেয়াল মারতে। বাসিন্দারা এখন হাঁস মুরগি ছাগলকে চোখের আড়াল করছেন না। ফলে অন্য ব্যবস্থা করতে হচ্ছে শেয়ালের দলকে।
বুনিয়াদপুর রেল স্টেশনে মুড়ি-বিস্কুটের লোভে সন্ধে-রাতে ভিড় করছে শেয়াল ছানারা। চায়ের দোকানদার অমূল্য রায়ে বলেন, ‘‘প্রথমটায় কুকুর বলে ভুল করেছি। মুড়ি, বিস্কুটও দিয়েছি। পরে লেজ দেখে বুঝতে পারি।’’ অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও জানান, মাঝে মধ্যে ছানাপোনা-সহ শেয়াল পরিবার দোকানগুলোর সামনে ঘুরঘুর করছে। মাঝে মাঝে স্টেশন চত্বরে থাকা কুকুরেরা তাড়াও করে শেয়ালদের। এর মধ্যে শেয়ালের আক্রমণের ভয়ও পাচ্ছেন স্থানীয় দোকানদার, ব্যবসায়ীরা।
পরিবেশ সংস্থার কর্মী বিশ্বজিৎ বসাক বলেন, ‘‘ঝোপজঙ্গলে শেয়ালের খাবারের টান পড়ায় তারা লোকালয়ে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে।’’ তাঁর দাবি, বন দফতর থেকে বিগত দিনে জেলার নানা জায়গায় শেয়াল ছাড়া হয়েছিল। বর্তমানে তাদের বংশবৃদ্ধি হওয়াতে এই বিপত্তি দেখা দিয়েছে। মাঠঘাট ঝোপ জঙ্গলের ছোট প্রাণীদের শিকার করে বেঁচে থাকে শেয়ালরা। গোসাপ, কাঁকড়া থেকে মেঠো বা ধেড়ে ইঁদুর ধীরে ধীরে কমে আসছে। এখনই বাসিন্দাদের সচেতন করা না গেলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা করছেন পরিবেসপ্রেমীরা।
বন দফতরের তরফে জানানে হয়েছে, শেয়াল সুমারি হয় না। তবে তাদের ধারণা দক্ষিণ দিনাজপুরের ৮টি ব্লকে প্রায় হাজার দশেক শেয়ালের বাস।
জেলার পরিবেশপ্রেমী তুহিনশুভ্র মণ্ডল বলেন, ‘‘খাদ্যশৃঙ্খল বজায় না থাকলে এরকম সমস্যা হয়। ভবিষ্যতে শহরের কুকুরের সঙ্গে আপোষ করে শেয়ালদের ঘুরতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy