Advertisement
০৬ মে ২০২৪
এজলাসে নৈরাজ্য

বিচার চেয়ে বিচারকেরা যাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টেই

এজলাসে কয়েক জন আইনজীবীর হাতে বারবার হেনস্থা হতে হলেও মাথা নোয়াননি তিনি। অথচ হেনস্থাকারীদের চাপের মুখে খোদ হাইকোর্টই শ্রীরামপুর আদালতের সেই বিচারক মন্দাক্রান্তা সাহার গুরুত্ব খর্ব করে দিল বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্দাক্রান্তাকে বর্ধমানে এমন এক পদে বদলি করা হয়েছে, বিচারকমহলের একাংশের মতে যার গুরুত্ব তুলনায় কম।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

এজলাসে কয়েক জন আইনজীবীর হাতে বারবার হেনস্থা হতে হলেও মাথা নোয়াননি তিনি। অথচ হেনস্থাকারীদের চাপের মুখে খোদ হাইকোর্টই শ্রীরামপুর আদালতের সেই বিচারক মন্দাক্রান্তা সাহার গুরুত্ব খর্ব করে দিল বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্দাক্রান্তাকে বর্ধমানে এমন এক পদে বদলি করা হয়েছে, বিচারকমহলের একাংশের মতে যার গুরুত্ব তুলনায় কম।

আবার সারদা-কাণ্ডে ধৃত রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের পক্ষ নিয়ে কিছু আইনজীবী আলিপুর কোর্টের বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায়কে এজলাসে দীর্ঘক্ষণ ঘেরাও করে রেখেছিলেন। বিচারককে উদ্দেশ করে নানাবিধ কু-মন্তব্যও করা হয়। তবু তিনি নতিস্বীকার করেননি। আইনজীবীদের এ হেন আচরণ দেখে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীরও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

শুধু এই দু’টো ঘটনা নয়। একই ভাবে কখনও তমলুক, কখনও পূর্ব মেদিনীপুর, কখনও জলপাইগুড়ি বা পুরুলিয়ায় বিভিন্ন বিচারক এক শ্রেণির আইনজীবীর অনভিপ্রেত আচরণের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তির শাসকদলের সমর্থক আইনজীবীদের একাংশের দিকে। আর বিচারকমহলের সিংহভাগের পর্যবেক্ষণ, সে কারণেই অন্যায়ের প্রতিকার হচ্ছে না। এমতাবস্থায় সমস্যার সুরাহা চেয়ে এ বার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে চলেছে বিচারকদের অন্যতম সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।’ বৃহস্পতিবার তাদের সিদ্ধান্ত, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ-মামলা দায়ের করা হবে।

অ্যাসোসিয়েশন-কর্তাদের দাবি, বিচারকদের প্রতি অবিচার, অন্যায় বদলি ইত্যাদি রুখতে তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, গত ২৫ এপ্রিল সংগঠনের বার্ষিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরও বলেন, বিচারক ও আইনজীবী— দু’পক্ষেরই আচরণ মার্জিত হওয়া উচিত। ‘‘দু’পক্ষেরই উচিত অহং (ইগো) ত্যাগ করা, দাম্ভিক না হওয়া।’’— সে দিন মন্তব্য করেছিলেন চেল্লুর।

কিন্তু অভিযোগ, কার্যক্ষেত্রে হাইকোর্ট এক পক্ষের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বিচারকদের বিপক্ষেই পদক্ষেপ করছে। ‘‘পাশে দাঁড়ানো দূরে থাক, উল্টে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে।’’— আক্ষেপ এক বিচারকের।

এবং এ প্রসঙ্গেই উঠে আসছে মন্দাক্রান্তা-বৃত্তান্ত। কী রকম?

অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তা এ দিন জানান, শ্রীরামপুর কোর্টের এক শ্রেণির আইনজীবীর লাগাতার হেনস্থা-অপমানের মুখেও অবিচল থেকে মন্দাক্রান্তা আইনি পদ্ধতিতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করছিলেন। প্রতিবাদে মন্দাক্রান্তার বদলি চেয়ে গত ৭ জানুয়ারি থেকে টানা অন্তত পঞ্চাশ দিনের বেশি তাঁর এজলাস বয়কট করেন কিছু আইনজীবী। জেলা জজ ও হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার সমস্যা নিরসনে ব্যর্থ হওয়ায় হাইকোর্টের প্রবীণ বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায় ও হুগলির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি নিশীথা মাত্রের হস্তক্ষেপে বয়কট ওঠে। সূত্রের খবর, বিচারককে নিগ্রহের জন্য শ্রীরামপুর আদালতের কয়েক জন আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করতেও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করা হয়েছিল।

তবে সে সবের এখনও কিছু হয়নি। ‘‘বরং হাইকোর্ট মন্দাক্রান্তাকেই বর্ধমানের রিজার্ভ অফিসার করে বদলির নোটিস ধরিয়েছে।’’— জানাচ্ছেন বিচারক সংগঠনের এক পদাধিকারী। আগামী ২ মে থেকে তাঁর বদলি কার্যকর হওয়ার কথা। রিজার্ভ অফিসারের কাজ হল, জেলার কোনও বিচারক ছুটিতে গেলে তাঁর দায়িত্ব সামলানো।

অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য: হাইকোর্টের এই নির্দেশ শুনে বিচারকদের মনোবল ভেঙে গিয়েছে। আর মন্দাক্রান্তার বদলির প্রেক্ষাপটেই সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ-মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কী কারণে অ্যাসোসিয়েশন এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল, হাইকোর্ট‌ের প্রধান বিচারপতির কার্যালয়কে তা-ও জানানো হয়েছে।

বিচারক মন্দাক্রান্তা সাহা নিজে অবশ্য এ দিন এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে শ্রীরামপুর বার লাইব্রেরির সম্পাদক রামচন্দ্র ঘোষ এ ক্ষেত্রে আইনজীবীদের কোনও ভূমিকা দেখছেন না। ‘‘এ রাজ্যে বিচারকদের নিয়োগ বা বদলি করে কলকাতা হাইকোর্ট। আইনজীবীদের কোনও ভূমিকা নেই।’’— মন্তব্য তাঁর। হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিসের দাবি: ফি বছর মার্চে বিচারকদের বাৎসরিক বদলি হয়। এ বছর তিনশোর বেশি জনকে বদলি করা হয়েছে, মন্দাক্রান্তা তাঁদেরই এক জন। ওই অফিসের এক সূত্রের কথায়, ‘‘ওঁকে কম গুরুত্বের পদে পাঠানোর অভিযোগ ভিত্তিহীন। বিচার ব্যবস্থায় সব পদই গুরুত্বপূর্ণ।’’

শুধু মন্দাক্রান্তা নন। অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি ও পুরুলিয়ার কয়েক জন বিচারকও নিম্ন আদালতে এক শ্রেণির আইনজীবীর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। এমনকী, তাঁদের গালিগালাজও করা হয় বলে প্রধান বিচারপতিকে জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তো বার কাউন্সিল রয়েছে! তারা কিছু করছে না?

বস্তুত ২৫ এপ্রিল সংগঠনের বার্ষিক অনুষ্ঠানে এসে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রুমা পালও একই প্রশ্ন তুলে গিয়েছেন। তিনি সে দিন মন্তব্য করেছিলেন, রাজ্য বার কাউন্সিলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি কার্যত অকেজো হয়ে পড়েছে, যার দরুণ আইনজীবীদের হাতে বিচারক নিগ্রহের ঘটনা বাড়ছে। বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অসিতবরণ বসু যদিও তা মানেন না। এ দিন অসিতবাবু বলেন, ‘‘আমাদের ১৯টি শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি রয়েছে। আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লে এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হয়। ২০১৪-র ৩৮টি অভিযোগের শুনানি আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবে।’’

তাতেও সংশয় কাটছে না। দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করাটা যে যথেষ্ট প্রমাণ ও সময়সাপেক্ষ, কাউন্সিলের একাধিক সদস্য তা একান্তে স্বীকার করছেন। হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের কথায়, ‘‘ওই সব আইনজীবীকে আক্ষরিক অর্থে শাস্তি না-দিলে বিচারক নিগ্রহে দাঁড়ি পড়বে না।’’

এমতাবস্থায় একমাত্র সুপ্রিম কোর্টই তাঁদের সুবিচার দিতে পারে বলে মনে করছে বিচারকদের ওই সংগঠন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE