আমহার্স্ট স্ট্রিট এলাকা। রাত ১০টা পেরিয়ে গিয়েছে। তখনও তিনটি বড় পুজো কমিটি ডিজে বাজিয়ে রাস্তা জুড়ে ধুন্ধুমার অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে। ঝালাপালা দশা স্থানীয়দের। অনেকেই মুখ খুলতে না চাইলেও এক বাসিন্দা বলে ফেললেন, ‘‘আমার দেড় বছরের নাতি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ৯০ বছরের বৃদ্ধা মা রাতে ঘুমোতে পারেননি। অন্যান্য বছরের মতো এ বারও কালীপুজোর পরের রাতটা জেগেই কাটাতে হল।’’
সোমবার রাত পৌনে ১১টা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পেরোতেই কানে এসেছিল হিন্দি গান। সেন্ট্রাল রোডের মুখে গাড়ি পৌঁছতেই দেখা গেল রাস্তা বন্ধ। অদূরে মঞ্চের গানবাজনা ছড়িয়ে পড়ছে কেপিসি হাসপাতালের চারপাশে।
সুবোধ মল্লিক রোড। তারস্বরে মাইক বাজিয়ে চলেছে বিসর্জনের শোভাযাত্রা। পিছনে পিছনে পুলিশ। স্থানীয়দের কয়েক জন এগিয়ে গিয়ে পুলিশকে মাইকের শব্দ কমানোর জন্য বলেন। জবাব আসে, শোভাযাত্রায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তাদের। অন্য কিছু তারা দেখবে না!
দক্ষিণেরই পাটুলি থানা এলাকায় অবশ্য ডিজে-জলসার হানাদারি রাত সাড়ে ১০টার পরে বন্ধ করে দেয় পুলিশ। সেখানেও কিন্তু স্থানীয় পুলিশ নিজে থেকে নামেনি শব্দশাসনে। অতিষ্ঠ বাসিন্দারা ১০০-তে ডায়াল করার পরে লালবাজার থেকে খবর যায়। এর পরে এলাকার পুলিশের কানে ঢোকে ডিজে-র তাণ্ডব!
দীপাবলিতে শব্দবাজি ঠেকানোই ছিল পুলিশের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খানিকটা সফল হলেও ডিজে-র হুঙ্কার ঠেকাবে কে! সেই ২০০৫ সাল থেকেই সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়ে রেখেছে, দায়িত্বটা পুলিশের। কিন্তু পাটুলি থেকে পোস্তা, বেহালা থেকে টালা— রাত ১০টার পরেও প্রকাশ্যে মাইক বাজিয়ে জলসা-শোভাযাত্রা অবাধে চলেছে এ বছরও। বরং অত্যাচারের মাত্রা চড়িয়েছে ডিজে-র কেরামতি। তার জন্য অনেক জায়গাতেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন পুজো উদ্যোক্তারা। প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁদের রোষে পড়তে হয়েছে পাড়াপড়শিকে। কিন্তু কোথাওই স্থানীয় ভাবে পুলিশকে উদ্যোগী হয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বা রাস্তা খুলে দিতে দেখা যায়নি এ বছর। বরং কেউ মাইক বাজানোর প্রতিবাদ করে মার খেয়েছেন, কারও বাড়ির কাচ ভেঙেছে, কারও বাড়িতে ঢুকে শাসিয়ে গিয়েছেন পুজোর উদ্যোক্তারা। ঘটেনি ধরপাকড়ের ঘটনা। ফলে পুলিশের কাছে নালিশ জানিয়ে নিজেরাই সন্ত্রস্ত অনেকে!
পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, সোমবার শহর জুড়ে মধ্যরাতের পরে মাইক বাজিয়ে যে অনুষ্ঠান হয়েছে, তাতে পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা রীতিমতো হতাশ করার মতো। কী করে আইন ভেঙে এই সব অনুষ্ঠান হল? নেতা থেকে পুলিশকর্তা, অধিকাংশই তার উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন। এক পরিবেশকর্মী বলেন, ‘‘মুম্বই পুলিশের কাছে শিক্ষা নিক লালবাজার। যত বড় শিল্পীই হোক না কেন, ওখানে রাত ১০টার পরে প্রকাশ্যে মাইক বাজিয়ে অনুষ্ঠান করতে দেয় না পুলিশ।’’ পরিবেশকর্মীদের দাবি, কলকাতায় যারা বিধি মানে না, পরের বছর পুলিশ যেন তাদের পুজোর অনুমতি না দেয়।
অনেকে এই প্রশ্নও তুলছেন, এখন তো অনেক এলাকাতেই অনুষ্ঠানের জন্য ভবন-মঞ্চ ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। সেগুলি ফাঁকা পড়ে থাকে। পুজোর পরে জলসার জন্য এগুলিকে কেন ব্যবহার করা হয় না!
• রাত দশটার পর প্রকাশ্যে কোথাও কোনও ভাবে শব্দযন্ত্র বাজানো যাবে না।
• বিধি লঙ্ঘনে কী সাজা: পরিবেশ সুরক্ষা আইন অনুযায়ী পাঁচ বছরের জেল বা এক লক্ষ টাকা জরিমানা। অথবা দুই-ই
• কে নজরদারি করবে: পুলিশ।
• রাত দশটার পরেও মাইক বাজছে দেখে পুলিশ কেন নিজে থেকে ব্যবস্থা নিল না?
• অভিযোগ এলেই পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। বেনিয়ম নজরে এলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেখানে হয়নি, সেখানে কেন পুলিশ তৎপর ছিল না তা খতিয়ে দেখব।
সুপ্রতিম সরকার যুগ্ম নগরপাল (সদর)
যাদবপুরে যেখানে রাস্তা বন্ধ করে রাত পৌনে ১১টায় অনুষ্ঠান চলছিল, সেখানকার তৃণমূল কাউন্সিলর কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ দেবব্রত মজুমদার বলেন, ‘‘দু’একটা ঘটনা ঘটেছে। রাত ১০টার পরে মাইক বাজানো অন্যায়। এ রকম ঘটনা আগামীতে যাতে না ঘটে সে বিষয়ে পুজো কমিটিগুলিকে সতর্ক করা হবে।’’ পাটুলি থানা এলাকার যে পুজোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার চেয়ারম্যান স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি জানি না।’’ তবে রাত ১০টার পরে মাইক বাজানো যে বেআইনি, তা মেনেছেন তিনি।
আমহার্স্ট স্ট্রিটে এক পুজো কমিটির অন্যতম কর্তা তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়। মঙ্গলবার রাতে তাঁর পুজো কমিটির উদ্যোগে রাত ১০টার পর জোরে বক্স বাজিয়ে অনুষ্ঠান হয়েছে। তাপসবাবু বলেন, ‘‘মঙ্গলবার রাতে আমি অনুষ্ঠানস্থলে ছিলাম না। তবে দর্শকের কথা রাখতে গিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হতে কোথাও কোথাও ১০টা পেরিয়ে যায়।’’
দত্তবাগানের ওই অনুষ্ঠানে কিছু ক্ষণের জন্য উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক মালা সাহা। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কোথায় কে ক’টা পর্যন্ত মাইক বাজাল সেটা কি আমার দেখার কথা?’’
দেখার কথা তবে কার? সুপ্রিম কোর্টের ২০০৫ সালের নির্দেশ, রাত ১০টার পরে প্রকাশ্যে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ। আইন ভাঙলে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। এই নির্দেশ না মানলে এক লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা পাঁচ বছরের জেল কিংবা দু’টোই প্রযোজ্য হবে। বেশ ক’বছর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে চলতে ক্লাবগুলিকে বাধ্য করেছিল লালবাজার এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। কিন্তু প্রশাসনের কড়াকড়ি উঠে যাওয়ায় ফের মধ্যরাতের জলসায় অতিষ্ঠ মহানগরীর মানুষ।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম নগরপাল (সদর) সুপ্রতিম সরকারের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘নির্দিষ্ট সময়ের পর মাইক বাজানোর অভিযোগ যখনই
এসেছে, পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। নজরদারির সময় কোনও বেনিয়ম নজরে এলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেখানে যেখানে হয়নি, সেখানে কেন পুলিশ তৎপর ছিল না, তা আমরা খতিয়ে দেখব।’’
পরিবেশকর্মীরা কিন্তু প্রশ্ন তুলছেন, সুপ্রিম কোর্ট যেখানে সরাসরি পুলিশকেই এ ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়ে রেখেছে, তবে তারা কেন অভিযোগের অপেক্ষায় বসে থাকবে? দক্ষিণ কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোডের এক ভুক্তভোগীর প্রশ্ন, রাস্তায় গাড়ির লাইসেন্স পরীক্ষা জন্য পুলিশের কাছে কেউ তো কোনও অভিযোগ করে না! পুলিশ সেটা
নিজে থেকে করে। মধ্যরাতে ডিজে-মাইকের অত্যাচার রুখতে পুলিশ কেন গা়ড়ির লাইসেন্স দেখার মতো সক্রিয় হবে না? কেন শান্তিরক্ষার নামে মধ্যরাতের ডিজে-মিছিলে পিছু-পিছু হেঁটেই দায় সারবে!
এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম নগরপাল (সদর) সুপ্রতিম সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy