Advertisement
১৮ জুন ২০২৪
Dengue

ডেঙ্গি চাপা দিতে মরিয়া পুর কর্তারা

মৃতদের পরিবার জানিয়েছে, সোমবার সকাল থেকেই তাপমাত্রা বাড়ছিল বাবা ও ছেলের। সন্ধ্যায় স্থানীয় চিকিৎসক দু’জনকে দেখে পরামর্শ দিয়েছিলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি। কসবার বি বি চ্যাটার্জি রোডে কেআইটি আবাসনের বাসিন্দা ওই দু’জন গত সোমবার একসঙ্গেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন।

শোকস্তব্ধ: ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয়েছে স্বামী ও ছেলের। শুক্রবার, কসবায় নিজের বাড়িতে বিভা ঘোষ।

শোকস্তব্ধ: ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয়েছে স্বামী ও ছেলের। শুক্রবার, কসবায় নিজের বাড়িতে বিভা ঘোষ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:১৮
Share: Save:

ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে বাবা ও ছেলের মৃত্যুর খবর চাউর হতেই নিজেদের দোষ খণ্ডনে ঝাঁপিয়ে পড়ল কলকাতা পুরসভা। ডেঙ্গি-দমনে পুরসভার ব্যর্থতা নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে, তার জন্যই কি এতটা অতিসক্রিয় পুর কর্তারা? দু’জনের ক্ষেত্রেই অবশ্য দুই হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছে, মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গি। তার পরেও মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) ডেঙ্গির তত্ত্ব খারিজ করতে যে সব যুক্তি সাজিয়েছেন, তাতে অন্তত তেমনটাই মনে হচ্ছে।

মৃতদের পরিবার জানিয়েছে, সোমবার সকাল থেকেই তাপমাত্রা বাড়ছিল বাবা ও ছেলের। সন্ধ্যায় স্থানীয় চিকিৎসক দু’জনকে দেখে পরামর্শ দিয়েছিলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি। কসবার বি বি চ্যাটার্জি রোডে কেআইটি আবাসনের বাসিন্দা ওই দু’জন গত সোমবার একসঙ্গেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। প্রথমে পার্ক সার্কাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তেরো বছরের ছেলে দীপকে ভর্তি করেন বাবা সিদ্ধার্থ ঘোষ (৫৩)। পরে বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন নিজে। কিন্তু কেউই আর বাড়ি ফিরলেন না। বৃহস্পতিবার মৃত্যু হল দু’জনেরই। দুই হাসপাতালের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেট অনুযায়ী ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয়েছে বাবা ও ছেলের। এ বছর কলকাতায় এটাই প্রথম ডেঙ্গিতে মৃত্যুর ঘটনা।

যদিও তা মানতে নারাজ কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতর। মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষের দাবি, ছেলের মৃত্যু ডেঙ্গির কারণে হয়নি। তার মৃগী ছিল আড়াই বছর বয়স থেকে। আর বাবার মৃত্যুর একটা কারণ হতে পারে ডেঙ্গি। তবে তাঁর হার্টেও সমস্যা ছিল। অতীনবাবুর যুক্তি, যে হাসপাতালে তিনি মারা গিয়েছেন, সেখানেই তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়েছিল। হতে পারে, সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল নিজেদের ব্যর্থতা চাপা দিতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডেঙ্গিকেই দেখিয়েছে। দিনভর এই চাপান-উতোরের মাঝেই ফের পুরসভার গাফিলতি নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন ওই আবাসনের বাসিন্দারা।

কসবার ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডে কেআইটি আবাসনের ঘোষ পরিবারে এখন শুধুই স্তব্ধতা। পুরসভা বনাম হাসপাতাল বিতর্কে তাঁদের কোনও হেলদোল নেই। বৃহস্পতিবার ডেঙ্গিতে মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরেই পুরসভার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, বাবা ও ছেলে দু’জনেই দিন কয়েক আগে চেন্নাই গিয়েছিলেন। সেখানে এখন খুব ডেঙ্গি হচ্ছে। হতে পারে চেন্নাইতেই তাঁদের শরীরে ডেঙ্গির জীবাণু ঢুকেছে।

দুই হাসপাতালের দেওয়া দু’জনের ডেথ সার্টিফিকেট। যাতে বলা হয়েছে, মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গি।

পুরসভার যুক্তি শুনে শুক্রবার ক্ষোভে ফেটে পড়েন ঘোষ পরিবারের আত্মীয়-পরিজনেরা। মৃত দীপের মামি সুজাতা ঘড়াই বলেন, ‘‘সিদ্ধার্থ বা দীপ তো নয়ই, পরিবারের কেউই সম্প্রতি চেন্নাই যায়নি।’’ তা হলে পুরসভার তরফে এমন অজুহাত খাড়া করার চেষ্টা কেন, তা নিয়েই শুরু হয়েছে জল্পনা। অতীনবাবুর জবাব, বৃহস্পতিবার ঘটনার পরে পুরসভার একাধিক কর্মী খবর নিতে গিয়েছিলেন। তখনই ওই আবাসনের কেউ কেউ বাবা ও ছেলের চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার কথা জানান। ওই দুঃসময়ে পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

পরিবার সূত্রের খবর, বছর দেড়েক আগে সিদ্ধার্থবাবুর হার্টে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। কলকাতারই এক বেসরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানান, তিনি অস্ত্রোপচারের পরে সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। একই ভাবে দীপের কোনও শারীরিক সমস্যার কথাও মেনে নিতে নারাজ তার পরিবার। তাঁরা জানান, দীপকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরে চিকিৎসকেরা রক্ত পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, তার ডেঙ্গি ধরা পড়েছে। বুধবার জানানো হয়, ডেঙ্গির প্রকোপে তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। আর দীপের বাবা সিদ্ধার্থবাবু বাইপাসের যে হাসপাতালে ভর্তি হন, সেখানেও তাঁর রক্তের আইজিএম (ডেঙ্গির জীবাণু রয়েছে কি না জানার পরীক্ষা) পরীক্ষায় জানা যায়, ডেঙ্গির জীবাণু রয়েছে। গত বুধবার রাত আড়াইটে নাগাদ হাসপাতাল থেকে খবর পাঠানো হয়, সিদ্ধার্থবাবু মারা গিয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টা নাগাদ জানা যায়, দীপও মারা গিয়েছে।
দুই হাসপাতালের রিপোর্টেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডেঙ্গির উল্লেখ রয়েছে।

এ দিন পুরসভাও ওই দু’জনের ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছে। তা উল্লেখ করেই পুরসভার দাবি, দীপের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে রক্তপরীক্ষা হয়নি। র‌্যাপিড টেস্ট করা হয়েছে। এলাইজা পদ্ধতিতে নয়। তাই পুরসভা ওই মৃত্যু ডেঙ্গির কারণে বলে মেনে নিতে পারছে না। দুই হাসপাতালের তরফেই জানানো হয়েছে, তাঁরা সমস্ত তথ্য ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য ভবনকে জানিয়েছেন।

এ দিকে, কসবার ওই আবাসনের বাসিন্দাদের অভিযোগ, কেআইটি-র আবাসন বলে সেখানে পুরসভার কোনও নজরদারি নেই। পুরসভার বক্তব্য, আবাসনের ভিতরে সাফাইয়ের
দায় পুরসভার নয়। সংশ্লিষ্ট আবাসন কর্তৃপক্ষের। তবে, গত মাসে চার বার ওই আবাসনে গিয়ে মশার লার্ভা নিধনের কাজ করেছে পুরসভা। আর এ মাসে সেখানে মশা মারতে ধোঁয়া ছড়ানো হয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলর বিজন মুখোপাধ্যায় জানান, ওই এলাকায় চার-পাঁচ জনের ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া হয়েছে বলে খবর মিলেছে। তবে তাঁর দাবি, এলাকায় নিয়মিত মশা নিধনের কাজ করেন পুরকর্মীরা।

ছবি: সুমন বল্লভ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dengue Mosquitoes Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE