ফুসফুসের টিউমারে আক্রান্ত রোগীর আত্মীয়েরা তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা দিয়ে একটি ক্যাথিটার কিনতে অস্বীকার করেছিলেন বলে সোজা এসএসকেএমের ক্যাথল্যাবে ঢুকে অস্ত্রোপচার থামিয়ে দেওয়ার ‘দাপট’ দেখিয়েছিলেন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি। তাঁর নালিশেই অজ্ঞান করা অবস্থাতে রোগীকে ওটি-র বাইরে বার করে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা।
শুক্রবার এই ঘটনার পরে লিখিত অভিযোগ হতেই তোলপাড় শুরু হয় স্বাস্থ্য দফতরে। পিজি কর্তৃপক্ষ থানায় অভিযোগ দায়ের করার পর শনিবারই পুলিশ হাসপাতাল থেকে রামকৃষ্ণ পাত্র ও সৌভিক শীল নামে দু’জনকে ধরে। ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাঁদের পুলিশি হেফাজত হয়েছে। অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করে পৃথক তদন্ত শুরু হয়েছে। এর আগে সুপার করবী বড়ালের নেতৃত্বে প্রাথমিক কদন্ত চালিয়ে সেই রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্যভবনে ও পিজি-র রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান অরূপ বিশ্বাসকে। সোমবার মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা নিজামুদ্দিন নামে ওই রোগীর অস্ত্রোপচার হয়েছে ।
এসএসকেএমের ঘটনার পর স্বাস্থ্য দফতর ঘোষণা করেছে, অক্টোবরের শুরু থেকেই রাজ্যের সমস্ত হাসপাতালে বিভাগীয় প্রধানদের মোবাইলে বিশেষ একটি ‘অ্যাপ’ চালু করা হবে। এটা দেখে তাঁরা প্রতিদিন তাঁদের হাসপাতালের স্টোরে কী ওষুধ আর চিকিৎসা-সামগ্রী মজুত রয়েছে তা জানতে পারবেন এবং সেই মতো জিনিসের আগাম বরাত দিতে পারবেন। তবে কতদিন সব চিকিৎসক এটা মেনে চলবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে স্বাস্থ্য দফতরেরও। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, এসএসকেএমে এত বড় ঘটনার পর সে দিনের অস্ত্রোপচারে জড়িত চিকিৎসকদের আপাতত বসিয়ে দেওয়া হল না কেন? এ ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তদন্ত শুরু হয়েছে। তার রিপোর্ট না-আসা পর্যন্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
এসএসকেএম থেকে ধৃত রামকৃষ্ণ পাত্রের সংস্থা স্বাস্থ্য দফতরে নথিভুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারী সংস্থার তালিকায় নেই। একই হাল সৌভিক শীলের সংস্থারও। তবু দু’জনেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পরে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন যে, গত প্রায় ৭-৮ বছর ধরে এসএসকেএমের ক্যাথল্যাবে তাঁদের অবাধ যাতায়াত। কার্ডিওলজির চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগও। এমন বেশ কিছু চিকিৎসকের নামও তাঁরা পুলিশকে জানিয়েছেন। তার জোরে খাস হাসপাতালের স্টোরে ব্যাগ ভরে তাঁরা নিজেদের সংস্থার জিনিসপত্র মজুত রাখতেন। এবং সেখান থেকে অস্ত্রোপচারের ঠিক আগে বা অস্ত্রোপচার চলাকালীন চিকিৎসকদের ফরমাইশমাফিক রোগীর বাড়ির লোককে জিনিসপত্র নগদে বিক্রি করতেন। সরকারি হাসপাতালে সব পরিষেবা, ওষুধ ও জিনিসপত্র ‘ফ্রি’ ঘোষণা হওয়ার পরেও তাঁদের এই বেআইনি কাজকর্মে ছেদ পড়েনি। কর্তৃপক্ষের নাকের ডগাতেই চলেছে।
প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগে এই এসএসকেএমেই কার্ডিওলজির এক বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, তিনি স্টেন্ট ও পেসমেকার সংস্থার প্রতিনিধিদের সরাসরি অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে ডেকে এনে রোগীর বাড়ির লোককে দিয়ে জিনিস কেনান। এর পরেও অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র কলকাতারই অন্য এক মেডিক্যাল কলেজে তিনি বদলি হয়েছিলেন।
পুলিশ জানিয়েছে, শুক্রবারের ঘটনায় ধৃত রামকৃষ্ণের বাড়ি যাদবপুরের বাপুজি নগরে। সৌভিক থাকেন হাওড়া শিবপুরে। ধৃতদের জেরা করার পর পুলিশ জানিয়েছে, এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীদের অনেকের সঙ্গে ওই দু’জনের যোগাযোগ রয়েছে। তারা দিনের বেশির ভাগ সময়ই ক্যাথল্যাবে চিকিৎসকদের সঙ্গে এবং ওয়ার্ডেই থাকতেন। তাঁদের সংস্থা রয়েছে নামেই। আসলে বাগরি মার্কেট থেকে কম দামে চিকিৎসা সামগ্রী কিনে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালেরই কিছু চিকিৎসকের বদান্যতায় তাঁরা সেগুলি রোগীর বাড়ির লোককে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতেন। চিকিৎসা সামগ্রীগুলির গুণমানের কোনও নিশ্চয়তা থাকত না।
প্রশ্ন হল, স্বাস্থ্য দফতরের কড়া নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও এঁরা কী করে হাসপাতালের অন্দর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছেন এবং চিকিৎসকদের কাছের লোক হয়ে উঠছেন? স্বাস্থ্যভবনে ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী কেনার দায়িত্বে থাকা এক উচ্চপদস্থ কর্তার কথায়, সবকিছু ‘ফ্রি’ হয়ে যাওয়ার ফলে কিছু চিকিৎসকের খুব মুশকিল হয়েছে। তাঁরা একদিন বিভিন্ন সংস্থার থেকে যে কমিশন পেয়ে এসেছেন তাতে টান পড়েছে। ফলে তাঁরা নানা অযুহাতে পুরনো সিস্টেম চালু রাখতে চাইছেন। এসএসকেএমের কার্ডিওলজির চিকিৎসক ধূর্যটিপ্রসাদ সিংহ যেমন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন, কোনও সামগ্রী অস্ত্রোপচারের সময় হাসপাতালের স্টোরে অমিল থাকলে সেটা যে রোগীর বাড়ির লোক বিনা পয়সাতেই ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান থেকে কিনে আনতে পারেন এই নিয়ম তাঁর জানাই ছিল না। তিনি জানতেন না যে, হাসপাতাল ওই টাকা রি-ইমবার্স করবে বা দিয়ে দেবে ন্যায্যমূল্যের দোকানকে।
স্বাস্থ্য দফতরের ওই কর্তা আরও জানান, প্রতিটি হাসপাতাল থেকে কার্ডিওলজির চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রত্যেক অপারেশনে কী কী লাগতে পারে সেই জিনিসের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই তালিকা বিশাল। তার মধ্যে কিছু জিনিস ফুরোতে শুরু করেছে বুঝলেই চিকিৎসকেরা স্টোরকে জানাবেন। স্টোর তখন সরকারি তালিকায় নথিভুক্ত সংস্থার থেকে তা কিনে নেবে। যদি এমন কোনও জিনিস দরকার হয় যা সরকারি তালিকায় নেই তা হলে সেটাও অস্ত্রোপচারের আগের দিন চিকিৎসকেরা জানাবেন। সেটা তখন স্টোর বাইরে থেকে কিনিয়ে রাখবে। কিন্তু বাইরের কিছু সংস্থাকে সুবিধা পাইয়ে দিতে অনেক চিকিৎসক অস্ত্রোপচারের আগে ইনডেন স্লিপ দিচ্ছেন না, যা এসএসকেএম-এ হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy